মহসীন শেখ:

মাস্টাররোল। পর্যটনের কর্মচারীদের জন্য এ যেন ভয়ানক অভিশাপ। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পর্যটনে চাকুরী করছেন নয়ন মল্লিক। বর্তমানে তিনি পরিচ্ছন্ন কর্মীর(ক্লিনার) দায়িত্ব পালন করছেন কক্সবাজার শহরের পর্যটন কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হোটেল শৈবালে। মাস্টাররোলে তার চাকুরীর পরে নিয়োগ পাওয়া অনেকেরই ভাগ্য পরিবর্তণ হলেও ভাগ্য নয়নের দিকে চোঁখ তুলে তাকায়নি এখনও। দেশের স্বনামধন্য স্বায়ত্বশাসিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় জীবনের অধিকাংশ সময় চাকুরী করলেও অর্থাভাবে করুণ দিনযাপন করছেন নয়ন। বর্তমানে তার পরিবারে ২ছেলে ১মেয়ে এবং স্ত্রী সহ ৪ জনের দৈনন্দিন খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বল্প বেতনে। মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা হলেও ৩ দিনের বেতন কেটে নিয়ে তাকে দেওয়া হয় ২৭ দিনে ৫ হাজার ৫‘শ টাকা। ছেলে মেয়ের পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া এবং খাবার জোগানে কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা। তাই পরিবারের খরচ মেটাতে চাকুরী শেষে রিক্সা চালান নয়ন।

একইভাবে হোটেল শৈবালে সিকিউটি পদে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চাকুরী করছেন মো: নেছার। দায়িত্বের বাইরে তিনি সেনেটারী মিস্ত্রীর কাজ করছেন নিষ্ঠার সাথে। তার ২ ছেলে এবং ১ মেয়ে ও স্ত্রী সহ ৪ জনের কষ্টের চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

নয়ন মল্লিক ও মো: নেছারের মতো হাবিব, শাহজাহান, জালাল, মুনির, কামাল, কাজল, আনন্দ, সোনা মিয়া, স্মৃতি রাণী, মিনু বড়–য়া, আব্দুর রহিম, করিম, হুমায়ুন, আলম, মোটেল উপলে কর্মরত পলক, বাবুল, ছাড়াও পরিবাবের কর্মক্ষম অসংখ্য ব্যক্তি দিনের পর মূল দায়িত্বে বাইরে কাজ করে গেলেও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি আদৌ। এদের মধ্যে অনেকের চাকুরী চলে গেছে নানা অভিযোগে। আবার অনেকেই মৃত্যুবরণও করেছে। এতে নিজেদের জীবনে হাতাশা নেমে আসলেও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন মহলের আন্তরিকতার অভাবে তাদের চাকুরী স্থায়ীকরণ হয়নি বলে জানিয়েছেন ভূক্তভোগীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানান, অনেক সময় রাতে এমনকি ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। উপরের কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা বাড়তি কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তারা ওভারটাইমও পান না। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় পর্যটনে মাস্টাররোলে চাকুরীরত কর্মচারীদের হতাশায় দিন করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, সারা দেশে নিযুক্ত কর্মচারীদের সুনির্দিষ্ট তালিকা থাকলেও তাদের উপরি মহলের সু-দৃষ্টি না থাকায় তারা বার বার অবহেলিত হয়ে আসছে। কর্মচারীদের অনেকে যথেষ্ট দক্ষতাস¤পন্ন। বিএ পাসও আছেন কেউ কেউ। কিন্তু, তা কোনো কাজে আসছে না। শুধু তাই নয়, সরকারি স্কেলে নির্ধারিত বেতনও তারা পাচ্ছেন না। দিনের পর দিন তাদের উপর এভাবে শোষণ করতে থাকলে যেকোন সময় সীমাহীন অবহেলা এবং বৈষম্যতার কারণে অধিকার আদায়ের জন্য ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন ওই কর্মচারী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের কক্সবাজার হোটেল শৈবালের ম্যানেজার সৃজন বিকাশ বড়–য়া জানান, স্থায়ীকরণ এবং বেতন বাড়ানো সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তদারকি করেন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদ। তবে স্ব স্ব প্রজেক্ট থেকে সুপারিশ পাঠানো হলেও নীতিমালা অনুযায়ী স্থায়ীকরণ এবং বেতন বাড়ানোর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তা কার্যকর হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অবহেলিত ওসব কর্মচারীদের একদিকে যুগের পর যুগ অতিবাহিত হলেও চাকুরী স্থায়ী না হওয়া, অপরদিকে স্বল্প বেতনে চাকুরীর কারণে দ্রব্যমূল্যের এ উর্ধ্বগতির সময়ে ওই কর্মচারীরা করুণ সময় পার করছেন। একই অবস্থা কক্সবাজারে পর্যটন কর্পোরেশনের পাঁচটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মাস্টার রোলে কর্মরত শতাধিক কর্মচারীর। যোগ্যতা থাকার পরও চাকুরী স্থায়ী না হওয়ায় বর্তমান সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন এসব কর্মচারীরা। অথচ সারা দেশে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাস্টার রোল ও অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত(আউটসোর্সিং) কর্মচারীদের জন্য প্রথমবারের মতো সর্বনিম্ন মাসিক সাকল্য বেতন নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে ২০ নম্বর গ্রেডে থাকা কর্মচারীর সর্বনিম্ন মাসিক বেতন দাঁড়াবে ১৫,৫০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৬ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীর বেতন হবে ১৭,০৪৫ টাকা। নতুন এই কাঠামো চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। একই সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বছরে দুটি উৎসব ভাতা ও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ প্রণোদনা দেওয়া হবে তাঁদের। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন কাঠামোতে মূল বেতন নির্ধারণ না করায় তাঁদের উৎসব ভাতা ও বৈশাখী প্রণোদনা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যটন কর্পোরেশনে এসব কর্মচারীরা এ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক ( প্রশাসন) এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পর্যটন কর্পোরেশনের মাস্টার রোলে কর্মরত কর্মচারীদের আউটসোর্সিংয়ে বাড়ানো বেতন র্কাকর নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যা শীঘ্রই র্কাযকর করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানান, যোগ্যতা থাকার পরও পর্যটন কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার অসহযোগীতার কারণে অনিচ্ছিত দিন যাপন করছেন শতাধিক কমৃচারী। যার খেসারতে আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে তাদের সন্তানরাও।

পর্যটন কর্পোরেশ সুত্রে জানাযায়, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের ৪০৩ তম সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত র্কাযসহকারীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকুরী স্থায়ীকরণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর পর্যটন কর্পোরেশনের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক(প্রশাসন) মো: মহসীন স্বাক্ষরিত কমিটির সদস্যদের দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে কমিটি সম্যকভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করে এর আইনগত গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অভিমত প্রদান করবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বয়স প্রমার্জনসহ নিয়োগের শর্তাবলী সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এ ছাড়া যে সকল কার্যসহকারীদের স্থায়ীকরণ করা হবেনা তাদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে এ কমিটি সুপারিশ রাখবে।

চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের ৪০৬ তম সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত র্কাযসহকারীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সামান্য বেতন বাড়ানোর কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি বলে সূত্রে জানিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে-দীর্ঘদিনেও এ কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেননি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক ( প্রশাসন) এসএমহুমায়ুন কবির বিষয়টি এড়িয়ে যান।

মাস্টার রোল ও অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত (আউটসোর্সিং) কর্মচারীদের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ঢাকা মহানগরের মধ্যে কর্মরত ১৬তম গ্রেডের আউটসোর্সিং কর্মচারীর বেতন হবে ১৭,০৪৫ টাকা। ঢাকা মহানগরীতে ১৭তম গ্রেডের বেতন ১৬,৫৫০ টাকা, ১৮তম গ্রেডে ১৬,২২০ টাকা, ১৯তম গ্রেডে ১৫,৮০০ টাকা এবং ২০তম গ্রেডে ১৫,৫৫০ টাকা হবে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকা ও সাভার পৌর এলাকায় ১৬তম গ্রেডের বেতন হবে ১৬,১১৫ টাকা, ১৭তম গ্রেডের ১৫,৭০০ টাকা, ১৮তম গ্রেডের ১৫,৫০০ টাকা, ১৯তম গ্রেডের ১৫,২০০ টাকা এবং ২০তম গ্রেডের বেতন হবে ১৪,৯৫০ টাকা। এসব এলাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে আউটসোর্সিংয়ে ১৬তম গ্রেডে কর্মরতদের বেতন হবে ১৫,৬৫০ টাকা, ১৭তম গ্রেডে ১৫,২০০ টাকা, ১৮তম গ্রেডে ১৫,০০০ টাকা, ১৯তম গ্রেডে ১৪,৭০০ টাকা এবং ২০তম গ্রেডে ১৪,৪৫০ টাকা।