আব্দুল্লাহ আল-মামুন, কাতার থেকে:
কাতারের বিরুদ্ধে আরোপিত সৌদি জোটর অবরোধের প্রায় তিন মাস হতে চললো। অবরোধের প্রথম দিকে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এখন সামনে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে কাতার। দক্ষিণে সৌদি আরব আর তিনদিকেই আরব্য উপসাগর ঘেরা ছোট্ট দেশ কাতার, চারটি দেশের দেয়া অবরোধর কারণে ভেঙ্গে পড়বে সহসা। এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্ত তা হয়নি। এখন দেশ্রপ্রেমের জোয়ারে ভাসছে কাতার। আরাম আয়াশের মধ্যে থাকা তেল সমৃদ্ধ দেশের ধনী নাগরিকদের মধ্যে এমন দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ কখনো দেখবো ভাবিনি। শুধু কি তাই? কাতারের নাগরিকদের পাশে এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এদেশে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের ২২ লক্ষ প্রবাসী মানুষ।
কাতার ছেয়ে গেছে বর্তমান আমীর শেখ তামিদের প্রতিকৃতি সম্বলিত পোস্টার, ব্যনার ও ফেস্টুনে। সাদা ক্যানভাসের উপর কালো রঙে আঁকা এই ছবিটি একেছেন আধুনিক ঘরানার একজন কাতারী চিত্রশিল্পী আহমদ আল-মা’দহীদ। এই ছবিটির সুবাদে রাতারাতি আহমদ পরিণত হয়েছেন সেলিব্রেটিতে। কাতারের ইতিহাসে কোনো শিল্পীর আঁকা প্রতিকৃতি এতোটা জননন্দিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। দোহা শহরের স্উুচ্চ অট্টালিকা, ছোটো-বড় গাড়ীর জানালা, উইন্ডশিল্ড, বহু বাড়ীর দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে এই প্রতিকৃতি। এটিএম মেসিনের স্ক্রিন. কম্পিউটারের ডেস্কটপ, মোবাইল ফোনের আবরন, এমনকি স্বর্ণের দোকানে গহনাতেও দেখলাম এই ছবি।
এই ছবিটিকে এখন কাতারের প্রতি আনুগত্য এবং স্বদেশপ্রেমের প্রতীক বলে গন্য করা হচ্ছে। দেশের এই দুঃসময়ে, রাজপথে নেমে তীব্র শ্লোগান দিয়ে নয় বরং এই প্রতিকৃতিকে মননে ধারন করেন নিরব অথচ দৃঢ় ভাষায় কাতারের অপামর জনতা দেশপ্রেমের বার্তা পাঠাচ্ছেন বিশে^র কাছে। শুধু কি তাই? আহমদের তুলির যাদুকরি ছোঁয়ায় কাতারের প্রতিটি মানুষরে হৃদয় এখন রূপান্তরিত হচ্ছে কাতারের প্রতি নিরন্তর ভালোবাসার নকশী ক্যানভাসে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে আমিরের প্রতিকৃতি সম্বলিত বিশাল আকৃতির বিলবোর্ড। এই সব পয়েন্টে পরিবার নিয়ে ভীড় জমাচ্ছেন হাজারো মানুষ। বিলবোর্ডোর বুকে ছবি এঁকে, বিভিন্ন ভাষায় দু’কলম লিখে সবাই জানাচ্ছেন কাতারের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও সমর্থনের কথা। এ এক অসাধারন অভিজ্ঞতা যা দিব্য চোখে না দেখলে অনুভব করা সত্যিই দুরূহ।
সুপার মার্কেটে কিছু কিছু খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু খাদ্য দ্রব্যের এখন ঘাটতি নেই বললেই চলে। দুগ্ধজাত পন্য, শাক-সব্জি ও ফলমূলের সরবরাহ মূলতঃ আসতো সৌদি আরব থেকে স্থল পথে। এখন সেই পন্য আসছে কার্গো বিমানে করে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এখন উন্নত মানের টমাটো আসছে মরক্কো, হল্যান্ড ও স্পেন থেকে। দুধ, দই, ও লাবান অসছে তুরস্ক, ইরান, বৃটেন, ফ্যান্স এমনকি আজারবাইজান থেকে। বিশাল আকৃতির ইরানী ও মরক্কোর তরমুজ দৃষ্টি কাড়ছে সবার। অস্ট্রেলিয়ার আলু ও কমলা; দক্ষিণ আফ্রিকা, কস্টারিকা, পেরু, চিলি, ও অর্জেন্টিনার মতো দেশেরও ফলমূল দেখলাম বাাজরে। ভারতের পামাপাশি চীনা আদা-রসুনও জায়গা করে নিয়েছে শেলফে। বাংলাদেশী শাক-সব্জিরও বেড়েছে চাহিদা। বাজারের বহু প্রতিযোগী আসাতে জিনিসপত্রের দাম একসময় আগের চেয়ে সস্তা হবে বলে সবাই আশা করছেন। এছাড়া আগের চেয়ে উন্নত মানের পন্য-সামগ্র্যী এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
দুবাই ও সারজাহ সমুদ্র বন্দর কাতারের জন্য বন্ধ করে দেয়ায় এখন যাবতীয় পন্য আসছে ওমানের সমুদ্র বন্দর ঘুরে কিংবা আকাশ পথে। ইতিমধ্যে কাতারে উৎপাদিত দুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা একজোট হয়ে প্রত্যাখ্যান করছেন সৌদি পন্য। ফলে কাতারী পন্যের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। এছাড়া খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী খাদ্য মওজুদ করার নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে কাতার। এজন্য নির্মিত হচ্ছে প্রায় ৬ লক্ষ বর্গ মিটার আয়তনের বিশাল ওয়্যারহাউজ। সরকার কৃষিখাতে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বনির্ভর হতে সচেষ্ট হয়েছেন এবং এজন্য সরকারী সহায়তার দেয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা হলেন মধ্যপ্রাচ্যের মরু দেশসমূহের সবুজীকরন এবং ওই সব দেশে শাক-সবব্জী উৎপাদনের পথিকৃত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাতারের কৃষিখাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাাহিত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে এই সঙ্কটে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কাতারে জাতীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা কাতর এয়ারওয়েজ। সৌদি আরব, আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরের আকাশপথ রুদ্ধ করে দেয়ায় বেশ কিছু ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে এবং বহু ফ্লাইটকে নতুন রুট খুঁজে নিতে হচ্ছে। কাতার এয়ারওয়েজকে এখন ওমান ও কুয়েতের বিমান বন্দরগুলোকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করছে। কাতারের পশ্চিমে বিশেষ করে দক্ষিণ মেরিকা ও আফ্রিকার আরব দেশগুলোতে যাবার পথ বেশ বিলম্বিত হচ্ছে। যেমন সুদান যেতে আগে আগে লাগতো ৩ ঘন্টা কিন্তু এখন ওমানের ঘুরে যেতে হচ্ছে বলে গন্ত্যবে পৌচতে লাগছে প্রায় দ্বিগুন সময় অর্থাৎ ৬ ঘন্টা। ফলে জ¦ালানীর জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে কাতার এয়ারেেয়জকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেশীর দেশের ইত্তেহাদ, আমিরাতস্-এর মতো বিমান সংস্থাকে ডিঙ্গিয়ে বিশে^র এক নম্বর বিমান পরিবহন সংস্থায় পরিনত কাতার এয়ারওয়েজ। এজন্য কিছুদিন আগে “এয়ার লাইন অফ দ্যা ইয়ারের” খেতাবও পেয়েছে। সৌদি জোটের দেশের দেশগুলো মেনে নিতে পারছেনা কাতার এয়ারওয়েজের এই নাক্ষত্রিক উত্থান । মনে হচ্ছে আকাশে পথে কাতারের আধিপত্যকে ক্ষুন্ন করার জনই আরোপিত হয়েছে এই আকাশ অবরোধ।
সৌদি জোট মনে করেছিলো অবরোধের কিছুদিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে কাতারের অর্থনীতি। খ্যাদ্যাভাবের জন্য দেশটিতে নেমে আসবে বিশৃঙ্খলা। কিন্তু ওরা যেমনটি চেয়েছিলো সেটি না হয়ে বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তা উল্টো। তড়িৎ গড়িতে খাদ্য সরবরাহের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে বের করে সৌদি জোটের দর্প চূর্ণ করে দিয়েছে কাতার। এছাড়া স্টক মার্কেট ও ব্যাংকিং খাতে অর্থ ঢেলে অর্থনীতিকে সচল রাখতে সমর্থ হয়েছে কাতার। কাতারের রয়েছে ৩৩৫ বিলয়ন ডলারের সঞ্চয় তহবিল। এছাড়া বিশে^ব্যাপী বিভিন্ন খাতে রয়েছে বিশাল অংকের বিনিয়োগ যার পরিমান কাতারের জিডিপির প্রায় ২৫০ শতাংশেরও বেশী। তাই সম্প্রতি মুডিস এবং এস এন্ড পির মতো সংস্থাগুলো কাতারের ঋণ নেয়ার সক্ষমতা কিছুটা হ্রাস করলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
কাতার ইতিমধ্যে ৮০টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা ছাড় দিয়েছে। ফলে বিশের কাছে কাতারের গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে এবং পর্যটন ও ব্যবসায়িক লেনদেন বৃদ্ধি পাবে। এদিকে তুরস্ক, কুয়েত, ইরান, মরক্কো, ওমান , রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের সাথে বানিজ্যক সম্পর্ক আরো জোরদার করার পদক্সেপ নিয়েছে কাতার। পাকিস্তানের করাচী সমুদ্র বন্দরের সাথে কাতার নতুন রুটও খুলেছে। কাতারে যে ব্যবসা-বনিজ্যেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে সেই সুযোগ বাংলাদেশও নিতে পারে।
কাতারের বিরুদ্ধে আরোপিত সৌদি জোটের আবরোধের যেমন কাতারের জন্য শাপে বর হয়েছে। এই প্রথম বারের মতো কাতারীরা একটি জাতি হিসাবে যেনো তাদের অর্ন্তনিহিত শক্তি খুঁজে পেয়েছে। তবে সবচয়ে বড় প্রাপ্তি হল বর্তমান সঙ্কট কাতারের শাসক গোষ্ঠিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্য থেকে কাতারর সাধারণ মানুষের আরো কাছে নিয়ে এসেছে।
(লেখকঃ প্রকৌশলী, গবেষক ও সঙ্গীত শিল্পী, জন্ম- কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।