বাংলা ট্রিবিউন

মিয়ানমারের এপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কড়া পাহারা। ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) টানা গুলি বর্ষণের শব্দ। আর সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গার আর্তনাদ। নারী, পুরুষ ও শিশুদের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি। বাড়িঘর, স্বজন, সহায়-সম্বল সব হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছেন তারা। যে যেভাবে পারছেন সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন এসব রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ১০টি পয়েন্টের সবখানে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

শনিবার (২৬ আগস্ট) বিকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইবনিয়া সীমান্ত পয়েন্টে স্থানীয় নুরুল ইসলামের আম বাগানে গিয়ে দেখা যায়, বিজিবি’র পাহারায় জটলা বেঁধে বসে আছে প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। এদের মধ্যে একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ মোস্তাক আহমদ। তিনি জানান, তার বাড়ি মিয়ানমার আরকান রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া গ্রামে। ৪ ছেলে ৬ মেয়ের মধ্যে ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। তিনি নিশ্চিত, তার ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। সে আর ফিরবে না। তাই তারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।.

ঘুমধুম সীমান্তে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা (ছবি: প্রতিনিধি)

রোহিনা আক্তার নামের এক গৃহবধূ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামীকে শনিবার সকালে বিনা কারণে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর একটি দল। আমার স্বামী আনোয়ার সেলিম নিরপরাধ। কিন্তু, তিনি উগ্রপন্থী দল ‘আলকিন’এর সদস্য বলে অভিযোগ করে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার চোখের সামনে ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করেছে। এ কারণে আমি বাংলাদেশে পালিয়ে এসে সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে।’.

 

বাংলাদেশ ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া ফকিরাপাড়া গ্রামের নুরুল বশর (৬৫), মুজিবুর রহমানসহ (৫০)  অসংখ্য রোহিঙ্গা জানান, শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুর ২টার দিকে সেদেশের একটি সামরিক হেলিকপ্টার ঢেঁকিবনিয়া সেনা ও বিজিপি ক্যাম্পে আসে। বিকাল ৩টার দিকে ওই হেলিকপ্টারটি চলে যাওয়ার পর পরই সেনা, বিজিপি ও স্থানীয় রাখাইনরা যৌথভাবে সীমান্ত সংলগ্ন ঢেঁকিবনিয়া, চাককাটা, ঢেঁকিপাড়া, ফকিরাপাড়া, চাকমাকাটাসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রামে হামলা শুরু করে। এ সময় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই বেধম মারধর করেছে। একারণে সে সব এলাকা থেকে তারা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আশ্রয় নিয়েছেন।.

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা (ছবি: প্রতিনিধি)

আরকানের একটি সূত্র জানায়, গত ২৪ আগস্ট বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংস ঘটনার পর থেকে তারা প্রকাশ্যে গুলি চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। প্রতিদিন যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার, জুলুম, বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পদও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে তারা।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় যুবকদের হাত-পা বেঁধে মাথা নিচু করে রাখে। এরপর গুলি করে হত্যা করছে। সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিছু রাখাইন যুবক। তাদের অত্যাচার সেনাবাহিনীর চেয়েও জঘন্য বলে দাবি তাদের। .

মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির পাহারা (ছবি: কক্সবাজার প্রতিনিধি)

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সে দেশের বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশসহ বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়। এঘটনার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। ফলে প্রতিদিন পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা। নাফ নদীর জলসীমানা থেকে শুরু করে স্থল সীমানা পার হয়ে আসছেন তারা। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু এর কোনও তোয়াক্কা না করে আরকানে ফের সেনা মোতায়েন করে নির্যাতন শুরু করে তারা।