আব্দুল্লাহ আল মামুন, কাতার থেকেঃ
দীর্ঘ চার দশক ধরে স্বদেশের সীমান ছাড়িয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছি দেশ থেকে দেশান্তরে। একজন প্রবাসী হিসাবে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ পালনের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ফলে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে ঈদ-উল-ফিতর ও কুরবানী ঈদের বহু স্মৃতিকথা।
মধ্যপ্রাচ্যের মরুর দেশ কাতারে আছি বেশ ক’বছর হল। আরবদের ঈদ পালনের ধরণ আমাদের দেশের চেয়ে একটু আলাদাই মনে হয়েছে। কাতারে ঈদের নামাজের সময় দেখে প্রথম ভড়কে গিয়েছিলাম। নামাজ হয় খুব ভোরে অর্থাৎ ফজর নামাজের আনুমানিক এক ঘন্টা পর। ঈদের ভোরে নতুন কাপড়-চোপড় পড়ে গায়ে সুগন্ধ আতর ও চোখে সুরমা লাগিয়ে দলবেধে সবাই ঈদগাহে যাবো, আমার কাছে এই হল ঈদ। কিন্তু খুব ভোরে ঈদের জামা’ত হয় বলে আমাদের দেশের মত দলবদ্ধ হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের জামায়াতে যাবার দৃশ্য মধ্যপ্রাচ্যের মরুর দেশে তেমন একটা চোখে পড়েনা। গরম আবহাওয়ার জন্যই হয়তো সুর্য্যের তাপ বাড়ার আগেই নামাজ শেষ করে ফেলার এই নিয়ম।
কাতারে প্রায় সব বড় মসজিদ এবং সরকারী স্কুলের প্রাঙ্গনে ঈদের জামায়াতের আয়োজন করা হয়। একবার নামায শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ পর এক বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে দেখি সবাই টানা ঘুম দিচ্ছেন। ভদ্রলোক ঘুম থেকে উঠে দরোজা খুলে দিয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ভোরে নামাজ পড়ে এসে সবাই একটু ঘুমিয়ে নিয়ে শুরু হয় তাদের ঈদের দিন। যারা পরিবার নিয়ে কাতারে আছেন, দেশের মতো এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়িয়ে জমিয়ে পালন করেন ঈদ উৎসব। তবে ব্যাচেলেরদের জন্য এখানে তেমন কিছু নেই। নামাজ শেষে বাসায় খাবার দাবার সেরে সবাই দলবেধে বেরিয়ে পড়েন। ভালো লাগার জায়গাগুলো হচ্ছে দোহা শহরের কর্নিশ, দুখান কিংবা ওয়াকরার মতো সমুদ্র সৈকত। কানে হেডফোন লাগিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ফেলে আসা পরিবার পরিজনদের সাথে ফোনালাপ সেরে তবেই তারা বাড়ী ফেরেন।
কাতারের রাজধানী দোহা শহরতলীর একটু দুরে রয়েছে পশুর খামার। সুন্দর ছাউনি দেয়া এই খামারে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত পানি ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় সব খামারেরই রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশি শ্রমিক। তাই কুরবানীর ঈদে পশু কিনতে গেলে দাম-দর করতে বিশেষ অসুবিধা হয়না। এইসব খামারে গরু, খাসি, উট ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়। পশু কেনার পর ক্রেতাকে একটি নাম্বার দিয়ে দেয়া হয়। কুরবানীর আগের দিন পশুটিকে খামার থেকে নিয়ে আসলেই চলে। বাংলাদেশিরা সাধারনতঃ কোনো কম্পাউন্ডের উঠোনে গরু জবাই এবং মাংস কাটা-কুটির ব্যবস্থা করে থাকেন।
তবে স্বদেশের ঈদের সাথে অন্য কিছুরই তুলনা হয়না। দেশে ঈদ-উল-ফিতরের সময় রমজানের শেষে ঈদের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়েই শুরু হতো ঈদ-আনন্দ যাত্রা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মধ্যে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য দেখা যেতো টান-টান উত্তেজনা। কোন জায়গায় দাঁড়ালে ঈদের চাঁদ পরিস্কার দেখা যেতে পারে সে নিয়ে চলতো গবেষণা। ছোটোবেলায় চাঁদ দেখার জন্য দল-বল নিয়ে আমরা কোনো উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে কিংবা খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়াতাম। কোনো কারনে চাঁদ দেখতে না পেলে যেমন কষ্টে ভেঙ্গে পড়তাম তেমনি আবার চাঁদ দেখতে পেলে দিকে দিকে উপচে পড়তো আনন্দের ফোয়ারা। সাইরেন, আতশ বাজির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো চারদিক। ঈদের আগমনী বার্তা শোনার পর সারারাত ধরে বাড়ীতে চলতো বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ যেমন ঘরবাড়ী ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা, দর্জির দোকান থেকে সেলাই করে আনা নতুন জামা কাপড় ইস্ত্রি করা, মেহেন্দী লাগানো ইত্যাদি। ওদিকে মা, খালারা বিভিন্ন পদের সেমাই ও রান্নার কাজে থাকতেন ব্যাতিব্যস্ত। ইদানিং হাই-রাইজ বিল্ডিংয়ের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় পাড়া-মহল্লায় খালি মাঠ তেমন আর চোখে পড়েনা। রিয়েল ষ্টেটের দালান-বাড়িগুলো যেনো অশুরের মতো গ্রাস করে নিয়েছে সমস্ত সবুজ মাঠ।
ঈদের দিন ভোরে কে আগে বাথরুম দখল করবে সে নিয়ে বাড়ীতে চলতো প্রতিযোগীতা। গোসল সেরে চোখে সুরমা লাগিয়ে নতুন পায়জামা, পাঞ্জাবী ও নাগরা পায়ে দিয়ে ছুটতাম সবাই ঈদগাহের পানে। চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠেই হতো তখন ঈদের সবচেয়ে বড় জামা’ত। এখন অবশ্য পলো-গ্রাউন্ড কিংবা জামায়াতুল ফালাহ্র মাঠে বড়সড় জামায়াত হয়। নামাজ শেষে বাড়ী এসে শুরু হতো সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব, সালামী নেবার পালা। বড়দের সালাম করলে সালামী পেতাম। বাবা ঈদের সালামী দেবার জন্য ব্যাংক থেকে নিয়ে আসতেন কড়কড়ে নতুন নোট। নতুন নোটের সুগন্ধটাই ছিল অন্যরকম। কে কত বেশী সালামী যোগাড় করতে পারে সে নিয়ে চলতো দুরন্ত প্রতিযোগীতা। বাড়ীতে সালাম নেয়া শেষ হলে পাড়াতো চাচা, খালারাও সালামীর দাবী থেকে রেহাই পেতেন না। দিন শেষে পকেটে কত জমা হলো তার উপর ভিত্তি করে ঠিক করতাম সালামীর টাকা নিয়ে কি করা হবে। এমন করে এবাড়ী ও বাড়ী বেড়ানোতে সারাটা দিন কেটে গেলেও কখনো ক্লান্ত মনে হতোনা । ছোটবেলায় নিয়েছি সালামী। আর এখন হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ বাড়ীর কর্তা হয়ে নিজের সন্তান এবং অন্যান্যদের সালামী দিচ্ছি। সালামী পাওয়ার মতো সালামী দেয়াতেও যে অপার আনন্দ তা এখন বুঝতে পারছি।
তবে হাইস্কুলে পড়ার সময় ঈদের দিনের একটি নিয়ম ছিল বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখা। ওই একটি দিন সিনেমা দেখার জন্য বাড়ীতে থেকে কোনোরকম ছাড়পত্র লাগতোনা। লালদীঘি মাঠের অদূরে ছিল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সিনোম হল রঙ্গম। এখানে আঁতেল কিংবা এলিট শ্রেনীর লোকজনেরা সিনেমা দেখতে আসতেন না। পাকিস্তান আমলের কথা। ঈদের দিনে এই সিনেমা হলে ঘটা করে মোহাম্মদ আলী কিংবা ফাটটিং স্টার সুধিরের মারদাঙ্গা ছায়াছবি রিলিজ দেয়া হতো। শহরের সহজ সরল আম-জনতা অধীর উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এই ধরনের ছবি উপভোগ করতেন। অন্যান্য সিনেমা হল বাদ দিয়ে নির্ভেজাল আনন্দের জন্য এই সিনেমা হলকেই আমরা বেছে নিতাম। তবে রঙ্গমে সিনেমা দেখতে গেলে দর্শকদের জন্য থাকতো বিশেষ উপহার আর তা হচ্ছে সময় সময় ছারপোকার কাটুশ-কুটুশ কামড়। নির্ভেজাল আনন্দের সাথে ছারপোকার কামড় তখন বিশেষ বোনাস বলেই মনে হতো।
একবার রঙ্গমে গিয়েছি সিনেমা দেখতে। চলছে খুবই জনপ্রিয় ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিনেমার শেষ পর্ব। নবার যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন। নবাবরুপী কিংবদন্তি অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের জা¦লাময়ী সংলাপ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল সবাই। চারদিক পিনপতন নিরবতা। সিনেমা শেষ হবার পর বিষন্ন মনে সবাই বের হচ্ছিলেন হল থেকে। কারন সবার প্রিয় নবাব ইংরেজদের কাছে হয়েছেন পরাস্ত। হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার সামনের সারিরই একজন দর্শকের মন্তব্য। উনি তার বন্ধুকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, “পলাশীর মাঠে নবাব সিরাজের পাশে যদি সুধীর (জনপ্রিয় ফাইটিং অভিনেতা) থাকতো তাহলে নবাব কখনোই যুদ্ধে পরাজিত হতেন না। সুধীর একাই ইংরেজদের কাবু করে ফেলতো।” বুঝুন অবস্থা! দর্শকটির কথা শুনে হাসিতে দম আটকে যাচ্ছিল। কিন্তু পাছে বিমর্ষ দর্শকদের রোষানলে পড়ি সেই ভয়ে কোনো রকমে হলের বাইরে এসে আমরা সবাই বাধভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়লাম। রঙ্গমে শোনা এই মন্তব্য এখনো আমার স্মৃতিতে এক চিলতে রৌদ্দুর হয়ে ভালো লাগার দীপ্তি ছড়ায়।
কক্সবাজারে কুরবানী ঈদের একটি ঘটনা এখনো আমাকে আলোড়িত করে। তখন স্কুলে পড়ি। কুরবানীর জন্য গরু কেনা হয়েছে। বাহার ছড়ার নিরিবিলি হোটেল সংলগ্ন আমাদের বাড়ীর উঠোনো একটি খুঁটিতে গরুটি বেধে রাখা হলো। সেই যুগে এখনকার মত বাড়ীর চারদিক উঁচু দেয়াল ও লোহার গেইট ছিলনা; কোমর উঁচু বাঁশের বেড়া দেয়া হত। কোরবানী গরু দেখে উচ্ছ্বসিত সবাই। ছোট-বড় সবাই মিলে গরুকে কাঠাল পাতা খাওয়াচ্ছিলাম। কিন্তু গরুটিকে অস্থির মনে হচ্ছিল। হঠাৎ করে দেখলাম গরুটি খুঁটি উপড়ে ফেলে
হরিনের মতো লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙ্গিয়ে ছুটতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে সবাই হকচকিয়ে গেলেও, গরু গেল গরু গেল বলে সরব হয়ে এলাকার পিচ্চিদের দল নিয়ে সবাই ছুটতে শুরু করলাম গরুর পেছন পেছন। গরুটি ছুটতে ছুটতে কক্সবাজার ডিসি হিলের পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিল। এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ফলে রাস্তার লোকজনও চেষ্টা করছিল গরুটিকে বশে আনতে। প্রায় ত্রিশ মিনিট এদিক ওদিক ছুটোছুটির পর গরুটিকে বাড়ীর দিকে আনা হচ্ছিল। পথেই দেখা হল আমার এক ফুপার সাথে। উনি যাচ্ছিলেন বাজারে। ঘটনা শুনে বললেন, গরুকে বশে আনা কোনা ব্যাপারই নয়। এমন কাজ তিনি আগেও করেছেন। গরুটি মোটামুটি শান্তই ছিল। কিন্তু উনাকে সামনে দেখেই হঠাৎ করে ক্ষ্যাপে গিয়ে ফুপাকে ঢুস মেরে বসলো। ঢুস খেয়ে ফুপা মাটিতে কাৎ। ওই করবানীর ঈদ ফুপার মাটি হয়ে যায়। ঢুস খেয়ে শরীরের ব্যাথা-বেদনা ও জ¦রে ফুপা বিছানায় কাৎ হয়ে পড়েছিলেন ক’দিন। কুরবানীর সেই স্মৃতি আমাকে এখনো নাড়া দেয়। আমার সেই ফুপা বেঁচে নেই। দোয়া করি আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন।
(লেখকঃ প্রকৌশলী, গবেষক ও সঙ্গীত শিল্পী, জন্ম- কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া)
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।