-তোফায়েল আহমদ
এবারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে এমনিতেই নানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রথম থেকেই। দফায় দফায় মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে দীর্ঘকাল ধরে। অনুপ্রবেশের নেপথ্যে যখন যুক্তিসঙ্গত কোন অজুহাত থাকে তখন আশ্রয়দানকারি এই হতভাগা দেশটির বাসিন্দারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য মায়াকান্নায় পিছিয়ে থাকেনা।
অন্ততঃ ১৯৭৮ সালে তদানীন্তন বর্মা সামরিক জান্তার ড্রাগন অপারেশন থেকে এ পর্যন্ত যতবারই রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে ততবারই কালের সাক্ষী হিসাবে আমরা স্থানীয় গনমাধ্যম কর্মীরা রয়েছি। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি-রোহিঙ্গাদের কিভাবে ঠেলে দিয়েছে ‘মগের মুল্লুক’ নামে পরিচিত বর্মার জান্তা সরকার। সেই হতভাগা রোহিঙ্গাদের বোঝা আমরা বছরের পর বছর ধরে আরেক হতভাগারা বয়েই যাচ্ছি।
গত ২৫ আগষ্ট যখন শুনলাম-মিয়ানমারে আবার একটা অঘটন ঘটেছে। তখনই খটকা লাগে মনে। এটা আগষ্ট মাস। এই আগষ্ট বাঙ্গালীর শোকের মাস-কান্নার মাস। ভয়াল ১৫ আগষ্ট, ১৭ আগষ্ট, ২১ আগষ্ট থেকে আগষ্টের আরো অনেক কালো দিন রয়েছে। আগষ্টের ঘটনা হলেই মনে হয় নেপথ্যে অন্য কিছু। তাই এ ঘটনার নেপথ্যেও মন থেকে সন্দেহটা দূর হচ্ছে না কিছুতেই। কেননা সিঁদুরে মেঘ দেখলে….।
এমনিতেই ১৯৯১ সালের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনার পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের মাথায় হাত বুলিয়ে রেখেছে দয়া মায়া দিয়ে। অভিযোগের অন্ত নেই যে-আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিই নানা ছল চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রেখেছে। এবারের ২৫ আগষ্টের আরাকান সহিংসতার ঘটনায় যে এই সমস্যা জিইয়ে রাখা শক্তিধরেরা জড়িত নেই তা বলা যাবে না। সন্দেহ বরাবরই থেকেই যায়।
আরাকানে (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা গত বছরের অক্টোবরে সেখানকার পুলিশ ছাউনিতে হামলা চালিয়েছিল তারাই এবারো হামলা চালিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের এই বিদ্রোহী সংগটনের নাম ছিল আল ্ইয়াকিন। পরবর্তীতে এটার নাম হয় ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (এআরএসএ) এই বিদ্রোহী সংগটনের নেতা পরিচয়ধারী আতাউল্লাহ জুনুনি একজন পাকিস্তানী নাগরিক। পরে সৌদি আরবে বেড়ে উঠেন তিনি। জানা গেছে এআরএসএ পার্টিও সৌদি আরবের রোহিঙ্গা বংশ্দ্ভোুত ধনকুবেরদের হাতে গড়া।
এবারের সহিংসতার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরব থেকেই হুন্ডিতে টাকা আসছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দালালদের নিকট। এই টাকা পাঠানো হচ্ছে আরাকান থেকে ফ্রিষ্টাইলে রোহিঙ্গাদের আনার জন্য। এ কারনে সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না-২৫ আগষ্টের আরাকান সহিংসতার ঘটনা নিয়ে। আসলে এ ঘটনা কি রোহিঙ্গারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য করছে নাকি আন্তর্জাতিক শক্তির খুঁটি হিসাবে ‘রোহিঙ্গা’ নামটিই কেবল ব্যবহৃত হচ্ছে-বলা মুশকিল।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাঁর এক বক্তব্যে এবারের রোহিঙ্গা সহিংসতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শুধু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সন্দেহ নয়-এবারের ঘটনায় দেশের সচেতন মহলও সন্দিগ্ধ। কেননা পাকিস্তানী নাগরিক বিদ্রোহী গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আনার কাজে সৌদি আরব সহ আন্তর্জাতিক এনজিও সহ নানা সহযোগিতার গন্ধ মিলছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী পরিচয়ে আরাকানে যারা কাজ করছে তারা কি বাস্তবিকই রোহিঙ্গাদের পক্ষে ? নাকি যে ঘটনা করলে মিয়ানমার বাহিনীকে ক্ষীপ্ত করা যাবে এবং তখন রোহিঙ্গাদের এপাড়ে ঠেলে দেওয়ার কাজিটি করা সহজ হবে ? কোনটা সঠিক-এটাও বলা মুশকিল।
তবে এটাতে কোন সন্দেহ নেই যে-রোহিঙ্গারা এখন আন্তর্জাতিক খেলার গুটি হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তিই তাদের নিয়ে খেলছে। গতকাল কুতুপালং হিন্দু পাড়া এলাকায় চার শতাধিক নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের আশ্রয়ে এরকম সন্দেহের বিষয়টি আরো ঘনীভুত হয়ে উঠে। কেননা এর আগে মিয়ানমার থেকে কোন সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের সাথে হিন্দুদের আসতে হয়নি। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার কারনে কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা-সন্দেহ-আশংকা-উদ্বেগ-উৎকন্ঠাসহ ভয়ভীতিতেই ডুবে থাকেন। নাফনদ নিয়ে আলোচনারতো শেষ নেইই। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতরবিল ও আঞ্জুমান পাড়া দিয়ে রোহিঙ্গার ঢল দেখে তৃণমূলের স্থানীয় একজন ক্ষমতাসীন দলের নেতা বললেন-আমরা কোথায় যাব ? ফিলিস্থিন-গাজা, ইরাক-ইরান, তুরষ্ক-সুদান, আফগান-পাকিস্তানের দূরত্ব কতটুকু ? লেখক ঃ তোফায়েল আহমদ, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক কালের কন্ঠ, কক্সবাজার।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।