মাহবুবা সুলতানাঃ
কোরবানির ঈদ প্রসঙ্গটি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে লিখব লিখব করেও লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ শেষ পর্যন্ত লেখাটি লিখে শেষ করার চেষ্টা করেছি।
কোরবানির ঈদ বা কোরবানির পিছনে এক মহান ত্যাগের ও মহিমার ইতিহাস আছে। যা সকল মুসলিম জাতিসমাজ কম বেশি সবাই জানে। তাই ইতিহাসটির বিশ্লেষণে না গিয়ে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশী। যখন আমরা ছোট ছিলাম। বাবা সরকারি চাকুরীজীবী হবার কারণে গ্রামের বাড়ীতে বছরে দুই ঈদে দুইবার যাবার সুযোগ পেতাম।
সারা বছর জুড়ে অপেক্ষায় থাকতাম ঈদের সেই অনাবিল আনন্দ উপভোগের জন্য। গ্রামটিতে তখন আমাদের বাড়িসহ গুটিকয়েক বাড়িতে গরু, মহিষ বা ছাগল-খাসী কোরবানি দেয়া হতো। ঈদের দিন ভোরে ওঠে গোসল করে রেডি হয়ে অপেক্ষা করতাম। কবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাষিত হয়ে কোরবানির দৃশ্যাবলী অবলোকন করব।
যেহেতু কম সংখ্যক বাড়িতে কোরবানি হতো তাই আমাদের বাড়িতে শতশত মানুষ জমে যেত। আমার দাদী ও আব্বুর প্রিয় ছিল মহিষ কোরবানি দেয়া তাই আল্লাহর কৃপায় প্রতিবছর একটা মহিষ ও একটা গরু কোরবানি দেয়া হত। আল্লাহর ওয়াস্তে সবাইকে দান-খয়রাতের দৃশ্য দেখে মন ভরে যেত।
আত্মীয়-স্বজন- প্রতিবেশি-গরিব-দুঃখীদের সবাইকে বিতরণের পরও ঘরে প্রচুর রান্নাবান্না হতো। সে খাবার গ্রামবাসী গরিব-দুঃখীদের খাওয়ানোর পর যা থাকতো তা আমরা ঘরের মানুষেরা দিন দুয়েক খেতে পারতাম এবং সেটাই ছিল আনন্দ, সেটাই ত্যাগের স্বার্থকতা।
আর এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টা বা আলাদা। এখন ঘরে ঘরে কোরবানি হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে মানুষের আয় উপার্জন দশগুণ বেড়ে গেছে। মনেহয় কোরবানি এখন আর ত্যাগের মহিমার কোন বিষয় নয়। কারো কারো কাছে এটা একটা বিরাট ফ্যাশন ও স্ট্যাটাসের বিষয় মনে হচ্ছে।
যার সামর্থ্য নেই সেও কিভাবে কিভাবে যেন কোরবানি দিচ্ছে!! এখন কোরবানির মাংশ গরিব-দুঃখীদের পেটে যাচ্ছে না। যাচ্ছে কুমির মার্কা ডিপফ্রিজে । তাই ফ্রিজের বিজ্ঞাপনেও বলা হচ্ছে,’গরুটা আস্ত আটবে তো!’ আর সারা বছর জুড়েই ২-৩ টা গরুর মাংশগুলি ফ্রিজাপ করে রাখা হচ্ছে। এই হচ্ছে বর্তমানে কোরবানির ত্যাগের মহিমা আপডেট ভার্সন।
এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। এদেশের সবচেয়ে নিম্নশ্রেণীর মানুষগুলির মধ্যে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এ রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতার। পেট ভরে খাবার মত তিনবেলা খাবার জুটেনা। তবে মেয়ে বিয়ে দেবার ক্ষেত্রে দেখা যায়,’ কলিজার টুকরা কন্যাসন্তানকে কিছু পড়ালেখা ও আরবি শিক্ষা দিয়ে বিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
বিয়ের পর মেয়ে যাতে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। সে নিমিত্তে মেয়ের বর নামক সকর্মক /অকর্মণ্যের জন্য নগদ যৌতুক দেয়া থেকে শুরু করে। নানান রকমের খরচাপাতি ফিরিস্তি করার নিমিত্তে,মেয়ের সুখের জন্য কত লাখ বাঙ্গালী বাবারা ভিটে মাটি পর্যন্ত বন্দক ও বিক্রি করে মেয়েকে দিয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। মেয়েকে বিয়ে দেবার নামে মনে হয় ওটা আরেকটি কোরবানি সদৃশতা।
শুধু এতটুকুতেই শেষ নয়। বিয়ের পর শুরু হয় দেয়া নেয়ার নামে সাজানো আরো হরেক রকমের নিয়মনীতি। আর কোরবানির ঈদের সময় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গরু দিতেই হবে নতুবা মেয়েকেই কোরবানির গরু হিসেবে শ্বশুরবাড়ির সবাই জবাই করে দিবে, এরকম পরিস্তিতির সৃষ্টি হয়।
এখন আসছি উচ্চশ্রেণীর শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষদের প্রসঙ্গে। এ উচ্চশ্রেণীতে চলে আরো বেশি অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বিয়ের সময় কি কি করা হয় তা নাই বা লিখলাম। বিয়ের পর শুরু হয় নানা অনুষ্ঠানের নামে নানান উপদ্রব। প্রতি বছর বছর কোরবানির সময় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হয় আস্ত আস্ত জীবিত গরুর সাথে বাজার ও।
মেয়ের বাপের বাড়ির লোকজনের বছর বছর গরু উপহার দেবার সামর্থ্য না থাকলেও শ্বশুরবাড়ির বড়লোক অন্যান্য বউদের জন্য তাদের বাপের বাড়ি থেকে বিশাল বিশাল গরু পাঠানো হয়। সুতরাং সম্মান রাখার নামে এ বউয়ের বাপের বাড়ির সামর্থ্য না থাকলেও দিতেই হবে বছর বছর আস্ত গরু।
নাহয় কিছু পরিবারে শ্বাশুড়ি কতৃক নাজেহাল আর নির্যাতনের মতো কাহিনী নীরবে নারীর বুকে ক্ষত করে অহরহ। নিশ্চয় বয়ষ্ক শ্বাশুড়িটিও যখন বউ ছিল তখন তাকেও এ রকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে কিনা প্রমান নেই কারো কাছে। তবে হতেও পারে তাহলে আহ্ কি ভয়ংকর সুন্দর প্রতিশোধ!! এটাই কি কোরবানির মহিমার নমুনা !!
এখন বলব মধ্যবিত্তদের কথা। সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক মধ্যবিত্তদেরও এখন কোরবানি দেয়াটা ফ্যাশন বা স্ট্যাটাসের ব্যাপার হয়ে দাড়াচ্ছে। আরে, ধারদেনা করে, গলা পর্যন্ত ঋণের বুঝা নিয়ে দু’চারটা কোরবানি দেয়ার কী মানে হয়? এটা কি আল্লাহর প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের নিমিত্তে ত্যাগের মহিমা? নাকি ফ্যাশন বা স্ট্যাটাসের জন্য কোরবানি দেয়া??
আর কতদিন চলবে এ খেলা? এর থেকে পরিত্রান পাবার কি কোন পথ নেই এ সমাজ বা রাষ্ট্রে? এর কি কোন সমাধান নেই? যুগ যুগ ধরে এ অসুস্থ-নোংরা, অমুসলিম আর ইসলাম বিরোধী মানসিকতার জয়জয়কার কি চলতেই থাকবে? আল্লাহর সন্তুষ্টকরণ যেখানে মূল বিষয়,সেখানে আল্লাহর সৃষ্টি মনুষ্য সমাজের বাহাদুরী তুচ্ছার্থক রং তামাশা বন্ধ হোক। সেটাই প্রত্যাশা করছি সকলের প্রতি।
লেখকঃ মাহবুবা সুলতানা, সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিস, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।