ইদ্রিচ খান মুরাদ :
সমাজবিজ্ঞানের মতে সীমান্ত এলাকায় অপরাধ সংগঠিত হওয়াটা স্বাভাবিক বিষয়। তবে সময়ে-অসময়ে, কারণে-অকারণে দেশের অালোচিত সীমান্ত এলাকা টেকনাফে যেন এই স্বাভাবিকতা হার মেনেছে! চরম পর্যায়য়ের দুঃসময় পার করছে ৫৬ কি.মি দৈর্ঘ্যের দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ নাফ নদী ও তার কূলে বেড়ে ওঠা নাফ পাড়ের বাসিন্দারা।
নৌ-পথে মানব পাচারের গেইটওয়ে, দেশে সমসাময়িক মাদকের হট-অাইটেম খ্যাত ইয়াবা ট্যাবলেটের স্বর্গরাজ্য প্রভৃতির পাশাপাশি নাফ নদীকে ঘিরেই রোহিঙ্গা সমস্যা যেন মোড় নিল নতুনভাবে।
“নিজ ভূমিতে পরবাস” প্রবাদটার সৃষ্টিকরণ যেন রাখাইন রাজ্যের নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের জন্যই! মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও অসামরিক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক মায়ের সামনেই সন্তানকে মস্তকহীন করা কিংবা পিতার প্রত্যক্ষে কন্যাকে ধর্ষণের মতো ঘটনাদিতে এখন অার অস্বাভাবিকতা বোধ করেননা রোহিঙ্গা মুসলিমরা! চোখের সামনেই জ্বলন্ত অাপন নিবাসের দৃশ্যপট যেন এরা মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাড়না যে সৃষ্টিগতভাবে এদেরও অাছে নাফপাড়ে না গেলে তা অাপনার কাছে পুরোপুরি বোধগম্য হবেনা।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অাসতে চাইলেও সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চাইছে। কিন্তু নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, উখিয়া, টেকনাফজুড়ে দীর্ঘ সীমান্তপথ পাহারা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর মতো জনবলের যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনীতে। পাহারাদানের মাধ্যমে হ্রাস করা গেলেও অনুপ্রবেশ যে পুরোপুরি ঠেকানে যাবে তা বলা মুশকিল। গত কয়েকদিনে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চিত্র প্রত্যক্ষ করলেই ব্যাপারটা সহজে অনুমান করা যায়।
নাফ অান্তর্জাতিক নদী এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যাটাও অান্তর্জাতিকই বটে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কোন সদস্য রাষ্ট্রের দুর্বল কোন জনগোষ্ঠী যদি ঐ রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন তবে এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করতে পারেন, প্রয়োজনে সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবারিত মৃত্যুর মিছিলে এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি মিটিং ডাকা হয়নি কেন?? এই বেদনাজনিত ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুধু প্রেস ব্রিফিং ই কি যথেষ্ট ছিল?? কোথায় গেল তথাকথিত ও.অাই.সি?? বাংলাদেশের দুই বন্ধু রাষ্ট্র ভারত-চীন অাজ পর্যন্ত নীরব কেন?? নাফপাড়ে ভেসে অাসা রোহিঙ্গাদের লাশের গন্ধ বুঝি অারব পর্যন্ত পৌছায় না! বিশ্ব-মোড়ল অামেরিকা তো চুপ থাকারই কথা!! বিগত অর্থ বছর থেকে অামেরিকা মিয়ানমারে নতুন নতুন সেক্টরে ইনভেস্টমেন্ট শুরু করছে; সদ্য বিগত হওয়া বারাক ওবামার দুই-দুইবার মিয়ানমার সফর থেকেই বিষয়টা অাঁচ করা যায়। ও.অাই.সি নেতা নির্বাচনে তো তৎকালীন অামেরিকা সরকারের পছন্দমাফিকতা বজায় রাখা হয়েছে বলেই মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিজ্ঞানী। কাজেই ওইদিকটা অাপাতত বাদ!
বেশ ক’টি অারব রাষ্ট্রের ব্যস্ততা টের পাওয়া যায় অস্ত্র কেনার ঝনঝনানির শব্দে। তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বী অপর অারব রাষ্ট্রকে যেকোনো উপায়ে ঘায়েল করতে পারলেই মনোঃতৃপ্তি! রোহিঙ্গা বাঁচুক-মরুক তাতে ওদের কি!!
এবার অাসি চীন-ভারতের কথায়;
চীনের সাথে মিয়ানমারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অন্য লেভেলের। মাঝেমধ্যে সীমান্ত নিয়ে হাল্কা বিরোধ-সম্ভাবনা দেখা দিলেও চীন-মিয়ানমারের অাত্মার সম্পর্কের কাছে সকল প্রকার বিরোধ যেন নুয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে ব্লু-ইকোনমি তথা সমুদ্র অর্থনীতিতে চীন একধাপ এগিয়ে। মিয়ানমারের সাথে চীনের সমুদ্র পথে হরেক রকমের সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য চীন এই মুহূর্ত রাখাইন রাজ্যকে মিয়ানমারের অনুকূলে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে বিশ্ব নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখতে যাওয়া শক্তিশালী ভারতও যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমানতালেই সূক্ষ্ম কূটনীতিক পারদর্শিতা দেখিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ভারতের এমুহূর্ত কৌশলগতভাবে তুলনামূলক ভালো জিও-লোকেশনে অবস্থানরত মিয়ানমারের তুষ্টিসম্পাদন দরকার।
পাশাপাশি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরিকরণের অাকাঙ্ক্ষাও যে ভারত অন্তঃপুরে লালন করছেনা তাও বুঝা মুশকিল! সব মিলিয়ে প্রভাবশালী ভূ-রাজনৈতিক খেলায়ড়দের মাঠে কেবল দর্শক-ভূমিকাতেই অাপাতত সীমাবদ্ধ বাংলাদেশ।
স্বদেশপ্রেমের তাড়নায় স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে; চলমান সংকটের সমাধান কোথায়? কূটনীনৈতিকপাড়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধনাত্মক বেগ সৃষ্টি ছাড়া সমাধানের পথ অাপাতত দেখা যাচ্ছে বলে মনে হইনা।
“কান্না ব্যতীত ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে ও একফোটা দুধ জোটেনা” থিওরিতে চলমান বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ অধিকার অাদায় করতে চাইলে প্রথম শর্ত হচ্ছে বিশ্বের কাছে জোরালো ভয়েস তুলে কথা বলা। যদিওবা এদিক দিয়ে অামরা এখনো পর্যন্ত কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। অান্তর্জাতিক ইস্যু হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের কাছে জোরালেভাবেই তুলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি পারদর্শী “রোহিঙ্গা ক্রাইসিস কমিশন” গঠন করা যেতে পারে। কমিশনের কাজ হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে অালাদা অালাদা বৈঠকপূর্বক জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসানোর তাগিদ দেওয়া, বাংলাদেশে অবস্থানরত মোট রোহিঙ্গার তালিকা প্রণয়ন, বাংলাদেশের মতো গরীব রাষ্ট্রের পক্ষে বিদেশী বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা যে অাদৌ অসম্ভব তা স্পষ্ট করে তুলে ধরা। পাশাপাশি অারব-লীগ, ও.অাই.সি’র সাথে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাবেন ঐ কমিশন।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক নোংরা খেলার এমন তালগোল পাকিয়ে যাওয়া অবস্থায় যে ক’টি রাষ্ট্র দরজার ওপার থেকে মুচকি হেসে মজা নিচ্ছেন এই কমিশন চাইলে তাদের হাসিতেও চিন্তার রেখাপাত ঘটাতে পারেন। স্রোতের টানে ভেসে অাসা অসহায় মানুষগুলো পেট বাঁচানোর তাগিদে যেকোনো সময় জড়িয়ে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকান্ডে। কাজেই, দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একসাথে অবস্থানের ব্যবস্থা করার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির সম্ভাবনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন- এমনটাই অাশা দেশবাসীর।
লেখক: নাফ পাড়ের সন্তান
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।