কাজী আলিম-উজ-জামান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। চীনে ব্রিকস সম্মেলনের আগে দুই নেতার করমর্দন। ছবি: রয়টার্স
ভারত ও চীন এই অঞ্চলের দুই ‘বড় ভাই’। আয়তনে, জনসংখ্যায় তো বটেই, এমনকি শক্তি-সামর্থ্যে, প্রভাব বিস্তারেও তারা দাপুটে।
নিজস্ব বলয় তৈরিতে তারা তৎপর। এই তৎপরতায় দেশ দুটি এত ব্যস্ত এবং এত সতর্ক যে, অনেক ঘটনা তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। অনেক কিছু দেখেও চোখ বন্ধ রাখে। আর শুনতে যেন না হয়, এ জন্য কানে দিয়ে রাখে তুলো।
প্রতিদিন শয়ে শয়ে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু ভিটেমাটি ছেড়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে, ডুবে মারা যাচ্ছে। শিশুদের নিথর দেহ বয়ে নিয়ে আসছেন স্বজনেরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাড়ি, পলায়নপর নারী-শিশুদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্বিচারে গুলি। তবু নির্বিকার মাও সে তুংয়ের চীন ও মহাত্মা গান্ধীর ভারত।
বাংলাদেশ যেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, দানাপানি দিচ্ছে, ভারত সেখানে সে দেশে আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর ফন্দি করে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত ও চীনের কী অবস্থান, সেটা বোঝার জন্য মিয়ানমারের প্রতি এ দুটি দেশের স্বার্থের ধরনটা আগে জানা দরকার।
প্রথমে বলা যাক ভারতের কথা। ভারতের দিল্লি, কাশ্মীরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। ভারত সরকার মনে করে, এই রোহিঙ্গারা তার দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়াতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার এরই মধ্যে অবৈধ রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কোনো অনুরোধ-আবেদনও তারা গায়ে মাখছে না। জাতিসংঘ বলেছিল, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেওয়া যায় কি না, তা ভাবতে। জবাবে ভারতের প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজেজু বলে দিয়েছেন, এ ধরনের প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য।
আমরা লক্ষ করছি, ভারত মিয়ানমার বিষয়ে যেকোনো বিবৃতি বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক, বিশেষ করে কোনো পক্ষ যেন সে অবস্থানকে ‘রোহিঙ্গাপন্থী’ বলে ব্যাখ্যা না করে।
অতি সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে ‘আক্রান্ত হওয়ার পর’ মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অভিযান চালায়। এ ঘটনায় নরেন্দ্র মোদির সরকার অং সান সু চি সরকারের সমালোচনা তো করেই নি, বরং ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ নামে যে গোষ্ঠী নিরাপত্তা বাহিনীর সীমান্তচৌকিতে হামলা করেছে বলে খবর এসেছে, তাদের বলেছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রথম দিনের হামলায় ৮০ জনের ওপরে সাধারণ রোহিঙ্গা নিহত হলেও বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১০ সদস্যের মৃত্যুতে।
এর ভেতর দিয়ে স্পষ্ট, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হলেও ভারত সরকার সমর্থনের পৈতা ধরেই রেখেছে। এর কারণ ভারত চায় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে। এটা নয়াদিল্লির ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ বাস্তবায়নেরই অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। যদিও তা চীন ও থাইল্যান্ডের তুলনায় কম। ভারত মিয়ানমারকে দুই বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদিও এ নিয়ে মিয়ানমারের বিশেষ সন্তুষ্টি নেই। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বেশ ধীর।
এ অবস্থায় সবার চোখ এখন নরেন্দ্র মোদির দিকে। কাল মঙ্গলবার তিনি চীনে ব্রিকসের মঞ্চ থেকে মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। তিনি কি রোহিঙ্গার মানবাধিকারের পক্ষে কিছু বলবেন?
কক্সবাজারের কাছে কুতুপালংয়ে ত্রাণের আশায় জড়ো হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবিটি গতকালের। ছবি: রয়টার্স
২.
এবার দেখা যাক চীনের স্বার্থগত জায়গাটা। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কী সেনা আমল, কী গণতান্ত্রিক আমল, সব সময়ই এ সম্পর্ক অটুট ছিল। বলা যায়, মিয়ানমারের পরীক্ষিত বন্ধু চীন। উত্তর কোরিয়া হাজার অন্যায় করেও যেমন সমর্থন পায় চীনের, মিয়ানমারও তেমনি সব কাজে চীনের ভালোবাসা পেয়ে থাকে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একাধিকবার রাখাইন প্রদেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েও শুরু করতে পারেনি শুধু চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতায়।
গত অক্টোবরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিধনের ঘটনায় জাতিসংঘ তদন্তে এলেও সরকার ও সেনাবাহিনী সমর্থন জানায়নি, কোনো সহযোগিতা করেনি। কিন্তু চীন মনে করে, মিয়ানমার যা করেছে ঠিক করেছে।
মিয়ানমারকে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কূটনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ার একাধিক কারণও রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের কিয়াকফু এলাকায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় চীন। অবস্থান জোরদার করতে চায় ভারত মহাসাগরে।
শুধু তা-ই নয়, গত এপ্রিলে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বেইজিং সফরে দুই দেশের মধ্যে অশোধিত তেলের পাইপলাইন নির্মাণ নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বিষয়েও দুই দেশের আলাপ-সালাপ হচ্ছে।
বেইজিং সম্প্রতি আরাকানি রাজনীতিবিদদের সে দেশে আমন্ত্রণ জানায়। এদের একজন হলেন আরাকান ন্যাশনাল পার্টির চেয়ারম্যান ড. আয় মং। কট্টর জাতীয়তাবাদী আয় মং অতিসম্প্রতি রাখাইন প্রদেশে সেনা মোতায়েন এবং ওই এলাকায় জরুরি অবস্থার দাবি জানান। তিনি রোহিঙ্গাবিরোধী মানুষ।
রোহিঙ্গাদের ওপর এত অত্যাচার, নির্যাতন চলল, তবু চুপ চীন। তাদের এই নীরবতা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।
আমাদের মনে হয়, চীন ও ভারত শক্ত অবস্থান নিলে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মানসিকতা বদল করতে বাধ্য হতো। কিন্তু বড় হয়েও ছোটই রইল দেশ দুটি।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।