– মাহ্ফুজুল হক
আমাদের এই কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলের মানুষ মগ জলদস্যুদের দ্বারা চরম লুটপাট, খুন-জখম-ধর্ষণের শিকার হয়েছে বহু বছর। মগদের জুলুমের কথা বাংলাদেশীরা এত বেশী শুনেছে ও জেনেছে যে, তার কথা কাউকে আর দলিল প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হয় না। ‘মগ’ শব্দটির সাথে জুলুম, অবিচার, অপশাসন, আইন না মানা প্রভৃতি বিশেষণগুলো জড়িয়ে গেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মগ মানে জুলুম, মগ মানে খুন-জখম, মগ মানে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নকারী, মগ মানে মুসলমানের সম্পদ জবরদস্তি দখলকারী, মগ মানে ধর্ষক। মগ একটি মূর্তিমান আতংকের নাম ; ভয়ংকর, নৃশংসতা ও অশুভ’র প্রতীক। এ কথা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, শয়তান হচ্ছে সকল পাপাচার আর দুরাচারের মূল, মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু, মানবিকতা-মানবতার দুশমন। আর এই মগ’রা হচ্ছে সেই শয়তানের প্রতিভূ, প্রেতাতœা।
এই মগেরা যে দেশে বা এলাকায় বাস করে, সেটিই হচ্ছে মগের মুল্লুক। বাংলা ভাষায় এই শব্দটি একটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। মগের মুল্লুক বললে আর কারো বুঝিয়ে বলতে হয় না যে, চরম অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান। আমি খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম – বাংলা অভিধানগুলোতে অতি সহজেই ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটি পাওয়া গেলেও কোন ইংরেজি ডিকশনারিতে তা হুবহু বা তার সমার্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় না। সেখানে লেখা আছে Lawless. Lawless country লেখা নাই। তার মানে বাঙালিরাই এই শব্দ বা প্রবাদটির সাথে বেশী পরিচিত, খুব সম্ভবতঃ মগদের দেশ বার্মার প্রতিবেশী হবার কারণে ও মগ জলদস্যুদের কৃত অপরাধের কারণে। আমাদের দেশেও যখন কোথাও অরাজক পরিস্থিতি দেখা দেয় তখন আমরা বলি, দেশটি মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ‘মীর জাফর’ নামটি এদেশে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকি নামরূপে যেমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তেমনি বিরাজমান অরাজক অবস্থাও ‘মগের মুল্লুক’ নামে আখ্যা পেয়েছে।
মগ’দের আবাসস্থলকে বলা হয় মগের মুল্লুক। মগ মানে একটি জনগোষ্ঠী আর মুল্লুক মানে দেশ বা জনপদ। মগের মুল্লুক বলতে সাধারণতঃ আমরা বুঝি, এমন একটি দেশ যেখানে মগেরা বাস করে। অন্য কথায়, মানে বার্মা (মিয়ানমার) এর আরাকান। এটাই মূল আভিধানিক অর্থ যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ অভিধানে লেখা রয়েছে। পাশাপাশি অভিধানে আর একটি অর্থও লেখা হয়েছে, Lawless country.. যার ব্যাখ্যা Oxford Dictionary তে দেয়া আছে এইরূপ : (of a country or area) where laws do not exit or are not enforced. (একটি দেশ বা এলাকা) যেখানে আইন নাই অথবা আইনের প্রয়োগ নাই। (of people or actions) without respect for the law. (জনগন বা কর্মকান্ড) পরিচালিত হয় আইন অমান্য করে।
আমরা বহু বছর ধরে শুনে এসেছি, পড়েছি এবং জেনেছি যে, বার্মা হচ্ছে মগের মুল্লুুক। শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মগদের নিষ্ঠুর ও অমানুষিক জুলুম-নির্যাতন-খুন-জখমের অনিশেঃষিত ধারাবাহিকতার ফলে সেই জনপদের নাম হয়েছে মগের মুল্লুক। বার্মার আরাকানে লক্ষ লক্ষ মুসলমান মগদের অমানবিক ও বেআইনী আচরণের শিকার কয়েকশত বছর ধরে। প্রায় ১৮ হাজার বর্গমাইলের একটি জনপদব্যাপী কয়েক শতক ধরে পরিচালিত জুলুমের প্রতিকারার্থে তাবৎ দুনিয়ার কোন পক্ষ থেকেই, (মানবতাবাদী ?) বৃটিশ বেনিয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তান সরকার, বাংলাদেশ সরকার বা জাতিসংঘ, কেউ কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। সম্ভবতঃ সমগ্র দুনিয়ায় এইটি-ই একমাত্র জনপদ যেখানে আইনের শাসন এক দুই বছর ধরে নয় বরং কয়েকশত বছর ধরে অনুপস্থিত। এমনকি বর্তমান আধুনিক যুগেও তার ব্যত্যয় হয়নি। সে দেশে বিচারের বাণী কখনো নীরবে নিভৃতে কাঁদেনি। বরং কেঁদেছে উচ্চ রবে এবং প্রকাশ্যে। ‘আইনের শাসন’ শব্দটির সাথে সেখানকার মুসলমানগন আদৌ পরিচিত নন। তারা সব সময়ই সেখানে আইনের অপশাসনই প্রত্যক্ষ করেছেন। নির্যাতনের শিকার কোন মুসলমান সে দেশে বিচার চেয়ে প্রতিকার পেয়েছেন, তার নজির নেই বললেই চলে। বরং প্রতিকার চাওয়ার ‘অপরাধে’ আরও বড় ধরণের ক্ষতির শিকার হবার দৃষ্টান্তই সেখানে বেশী। তাবৎ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার চাপে পড়ে বর্মী নেত্রী অং সান সু চী রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে একটি দিক নির্দেশনামূলক রিপোর্ট তৈরির জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে এক কমিশন গঠন করেন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে গঠিত, ওই আন্তর্জাতিক কমিশনের প্রধান কফি অনান মিয়ানমারকে (বার্মা) বর্বর রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
মাথা মুন্ডানো, রক্ত লাল পোষাকে আবৃত, রক্ত চক্ষু আর রক্তাক্ত তরবারি হাতে দানব সদৃশ এক বীভৎস, কদাকার সঙ (ভান্তে) এসে আমার বাড়ির পাশে, আমারই চোখের সামনে আমার ভাইকে কেটে টুকরো টুকরো করছে, আগুনে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে, আমার বোনকে জবাই করছে, মা-বোনকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করছে, শিশুকে বলাৎকার করছে, জীবন্ত মানুষকে গাছে লটকিয়ে রেখে মরা পশুর গোশত ছাড়ানোর মতো করে ধারালো দা-চাকু দিয়ে মানুষের গোশ্ত কেটে নিয়ে কাবাব বানিয়ে খাচ্ছে, পৈচাশিক কায়দায় অট্টহাস্য করছে, অসহায় বনি আদমের আর্ত চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠছে, ঘর-বাড়ি-সম্পদ লুট করছে, মসজিদ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। এক ভয়াল কাহিনী। চারিদিকে মৃত্যুর বিভীষিকা। পুরো রোহিঙ্গা জনপদ এখন যেন মৃত্যুপুরী। (গত ০১.১২.২০১৬ তারিখ লেখা কলাম থেকে)। জাতিসংঘ দাবী করছে যে, বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিমরা হচ্ছে দুনিয়ার সবচাইতে নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী।
এক রক্ত লোলুপ ভান্তে (গড়হশ), যে রঙ মেখে সঙ সেজেছে। তার নাম অশিন উইরাথু (ভিরাথু), এক সন্ত বা ঠাকুর বা ভা-ন্তে। সে নাকি অহিংসার প্রচারক, ধ্বজাধারী, মহামতি বুদ্ধের ধর্ম প্রচারক বা মহাথেরো। তারা নাকি রক্ত প্রবাহিত করাকে মনে করেন হিংসার প্রতীকরূপে। তাই বৌদ্ধরা পশু হত্যা করেন না। বলেন, জীব হত্যা মহাপাপ। তবে মরা পশুর গোশ্ত খান। পশুকে মেরে তবেই তো তার গোশ্ত খাওয়া যায়। গোশ্তই যদি খাবে তো ওটাকে মারবে কে- অন্য কথায়- তার রক্ত প্রবাহিত করবে কে? তাদের দৃষ্টিতে খুব সম্ভবতঃ ‘জীব’ বলতে রোহিঙ্গা নামক মানুষকে নয় বরং গরু, ছাগল, শুকর ইত্যাদিকে বুঝানো হয়ে থাকে! রোহিঙ্গারা তো মানুষ, জীব নয়। সুতরাং রোহিঙ্গা নামীয় মানুষ হত্যা করো, তবে সাবধান জীব হত্যা করো না, তা যে মহাপাপ! তাদের প্রবঞ্চণার শুরু এখান থেকেই। আর ওই প্রবঞ্চকদের গুরু ওই সন্ত-মহন্ত-থেরো।
‘খ্রিস্টীয় পনের শতকের মাঝামাঝি থেকে মগ জলদস্যুরা মেঘনা নদীর মোহনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ উপকূলে নির্বিচার লুন্ঠন আর হত্যাকান্ড চালায়। ঐতিহাসিক ভ্যান লি ছোটেন লিখেছেন, জলদস্যুরা ছিলো বন্য জন্তুর মতো বর্বর। ন্যায়নীতি বলতে কিছু ছিল না তাদের। সমকালীণ ইতিহাসবিদদের লেখায় বাংলার উপকূলের নর-নারীদের প্রতি মগ জলদস্যুদের নিষ্ঠুর অত্যাচার, হত্যা আর ধরে নিয়ে দাসে পরিণত করার যে বিবরণ পাওয়া যায় তা শিউরে ওঠার মতো এবং লোমহর্ষক।
এন এম হাবিব উল্লাহ ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, এককালে বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, নোয়াখালী অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। গৌড়ের শাসকেরা এ অঞ্চল থেকে বিপুল রাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে এসব এলাকা এক সময় আবার জনশূর্ণ্য হয়ে পড়ে এবং গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়। সমকালীণ ঐতিহাসিক শিহাব উদ্দিন তালিশ মগ দস্যুদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, মেঘনা নদীর মোহনা থেকে অববাহিকা উর্ধ্বদেশে প্রবেশ করে মগ দস্যুরা গ্রামের পর গ্রাম লুট করে জ্বালিয়ে দিত। গৃহপালিত পশুও এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না। গ্রামবাসী নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে লোকজনদের ধরে দস্যুরা এক জায়গায় জড়ো করতো। অতঃপর গরম লোহার শিক দিয়ে দস্যুরা তাদের হাতের তালু ছিদ্র করত। তারপর চিকন বেত ছিদ্র পথে চালিয়ে দিয়ে বেঁধে ফেলত। বেতের অপর মাথা ধরে সবাইকে জাহাজের কাছে নিয়ে গিয়ে পাটাতনে ফেলে রাখত। মুরগীকে যেভাবে সিদ্ধহীন চাল ছিটিয়ে দেয় তদ্রুপ বন্দীদের উপর চাল সকাল বিকাল জাহাজের ছিদ্রপথে ছিটিয়ে দিত। এহেন অত্যাচারের পর যেসব লোক বেঁচে থাকত তাদের আরাকানে নিয়ে গিয়ে কৃষিকাজে নিয়োজিত করত। অনেককে দাস হিসেবে বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দিত। এমনকি অনেক সৈয়দ বংশীয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনকেও এহেন অবমাননাকর জীবন যাপন করতে হয়েছে। ইতিহাসবিদ মেনরিকের লেখায় ধরে নিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ধর্মান্তর করারও চেষ্টা করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব ‘বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী কোন জনগোষ্ঠীই এখানকার আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়। লেউইন ১৮৬৯, খিশা ১৯৬৪, বার্নট ১৯৬০ এবং আহমদ ১৯৯০ প্রমুখের গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জনগোষ্ঠীই আগে বা পরে পাশে অথবা একটু দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল বা সমতল ভূমি থেকে দেশান্তরি হয়ে ওইসব অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং নিবাস গড়ে তোলে। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমারা মিয়ানমার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মারমারা আরাকান থেকে এসেছে। চাকমারা মোগল শাসনামলের শেষ দিকে এবং বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে প্রবেশ করে। লেউইনের মতে ১৭৮৪ সালে মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। বোমরা মিয়ানমার-চীন পর্বত থেকে তাশন পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত ১৩.৮.২০১৭।)
শুধুমাত্র চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাভাষি, নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি বংশোদ্ভূত ও মুসলমান হওয়ার কারণে মিয়ানমারের আরাকান এলাকার ভূমিপুত্র (সান অব দা সয়েল) হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা সেখানে পরদেশী। অথচ রোহিঙ্গারা হাজার বছর ধরে রোসাং তথা বর্তমান আরাকানের অধিবাসী। দূর্গম পাহাড় আরাকানকে মূল বার্মা থেকে আলাদা করে রেখেছে। সেই কারণেই খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে বৃহত্তর ভারতবর্ষের সঙ্গেই আরাকানের যোগাযোগ ছিলো। ১৭৮৫ সনে বর্মী শাসক বোধপায়া আরাকান দখল করে প্রায় ২০ হাজার আরাকানীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং কয়েক লক্ষ লোক পালিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। ওয়াল্টার হেমিল্টন ১৮০২ সনে রামুতে এক লক্ষ এর অধিক আরাকানী শরণার্থী দেখেছিলেন। ১৯৪২ সনে বৃটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অনুরূপ সংঘঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় এবং পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী এখানে পালিয়ে আসে। ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তিম সময়ে বৃটিশরা পুরো উপমহাদেশে মুসলিম নিধনের সুযোগ করে দেয় আরাকানকে দু’ভাগে ভাগ করে যার একটি অংশ বাংলাদেশে আর অপরটি বার্মায়। যেমনটি তারা করে গিয়েছে কাশ্মীরে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক চট্টগ্রামের কীর্তিমান পুরুষ মাহ্বুব-উল-আলম ১৯৪৮ সালের ২রা জানুয়ারী লিখেন, ’১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে আরাকানে অশান্তির দরুণ উহার অধিবাসী মগেরা এত অধিক সংখ্যায় চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয় যে, চট্টগ্রামের কর্তৃপক্ষ তাহাদের বসতির জন্য একটা পরিকল্পনার প্রয়োজন অনুভব করেন। তাঁহারা কাপ্তেন কক্স’কে এই কাজের ভার দিয়া পাঠাইয়া দেন। তিনি আশ্রয় প্রার্থী মগদের জন্য একটা উপনিবেশ স্থাপন করেন। ইহাই পরিশেষে কক্সবাজার নামে খ্যাত হয় এবং কালক্রমে মহকুমার হেড কোয়ার্টারে পরিণত হয়।’ সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ লেখেন, ‘প্রাচীণ সমৃদ্ধ আরাকানের বিপর্যয়ের শুরু মূলত ১০৪৪-১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ রাজা আনাওরথার আগ্রাসনের সময় থেকে। তিনি হাজার হাজার স্থানীয় রোসাং, রোহাং এবং রেকং বা রাখাইনদের হত্যা করেন ; দেশত্যাগী হয় লাখ লাখ আরাকানি। ঐতিহাসিকেরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, রাখাইন, মারমাসহ অনেক জনগোষ্ঠী সে সময়ই দেশত্যাগী হয়ে বাংলাদেশে বসত করে।’
এখন কেউ যদি তর্কের খাতিরে দাবী করেন, যেহেতু তারা আরাকানের রাখাইনদের ভাষাভাষী, নৃতাত্ত্বিকভাবেও মগ বংশোদ্ভূত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, সুতরাং বাংলাদেশে অবস্থানরত রাখাইন, চাকমা, মারমা, বোমরা বাংলাদেশী নয়। তারা বর্মী এবং তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া উচিত। তাহলে তা মিয়ানমারের দাবীর যথোপযুক্ত জবাব হয় বটে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা হিংস্র মগদের মতো আহাম্মুকে কথা বলতে যাবো কেন ? কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে বলে মানুষও ঘেউ ঘেউ করবে, তা হয় না। মগরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, মুসলমানরাও তাদের মতো এদেশে বর্মী মগদের স্বগোত্রীয়দের উপর তদ্রুপ অমানবিকতা দেখাতে পারে না। এখানেই মুসলমান আর অমুসলমানের মাঝে তফাৎ। মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ।
এএফপি ও রয়টার্স পরিবেশিত খবর, জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের তিনটি জেলায় প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। মিয়ানমার বা প্রতিবেশী বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। মিয়ানমার সরকার ও বার্মিজ জাতির অনেকেই তাদের রোহিঙ্গা বলেও স্বীকার করে না ; বরং তাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে।’ এশিয়ান করেস্পনডেন্ট ডট কম এর মিয়ানমার ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিবেদক ফ্রান্সিস ওয়াদে তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বারবার জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের শিকার হয়েছে। একবার ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী জয়জয়কারের সময়, একবার আশির দশকের গোড়ায় এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। প্রতিবারই সেনাবাহিনীর হাতে অজস্র রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে এবং বাদবাকিরা হয়েছে বিতাড়িত।’ তিনি লেখেন, ‘পুলিশ বাহিনী আরাকানদের সঙ্গে মিলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘর বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে। পুলিশ মুসলমান জনতার উপর গুলিবর্ষণ করেছে। খেয়াল রাখতে হবে, মুসলমানরা মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনী বা সেনাবাহিনীতে নিষিদ্ধ। একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নিহত মুসলিমদের মাথা মুড়িয়ে, গেরুয়া পোষাক পরিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর তাদের ছবি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে অভিযোগ করা হবে যে, মুসলমানরা এসব ব্যক্তিকে হত্যা করেছে।’
এতদিন আমরা শুনে এসেছি মগ নামীয় হায়েনারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করছে, ধর্ষণ করছে, জীবন্ত পুড়িয়ে ভস্ম করছে, সহায়-সম্পদ লুট করছে, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, বাপ-দাদার বাস্তুভিটা থেকে চিরতরে উৎখাত করে তা দখলে নিচ্ছে। কয়েকদিন আগে বিবিসি থেকে প্রচারিত সান্ধ্যকালীণ খবরে শুনলাম, আরাকানে বসবাসরত দুই শতাধিক হিন্দু পরিবারও পালিয়ে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে হিন্দুপাড়া হরি মন্দিরের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া আরো বিপুল সংখ্যক হিন্দু রোহিঙ্গা বার্মা-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে মানবেতর অবস্থায় অবস্থান করছেন। তার মানে সাক্ষাৎ দানব মগরা আরাকানে মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে পুরো রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে উৎখাত করছে।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, আধুনিক বিশ্বে দুই শতাধিক কোটি মুসলমান, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও আই সি, আরব লীগ সবাই নেশার ঘোরে বুঁদ হয়ে আছে। জাতিসংঘ তাদের রুটিন কাজ হিসেবে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করে, উদ্বেগ প্রকাশ করে। গত বছর মালয়েশিয়ার কিছুটা নড়াচড়া লক্ষ্য করেছিলাম। সৌদি আরব, আরব আমিরাত যারা কথায় কথায় ইয়েমেন, কাতারের মতো মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়, তারা এ বিষয়ে টু শব্দটিও করে না। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের তুরস্ক। ২৭ অগাস্ট, ২০১৭, সোমবার এক লাইভ টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় বিশ্ব আজ ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব এটি শুনতে পায় না এবং এটি দেখতে পায় না। বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ এই ঢলকে তিনি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেন এবং আগামী মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিষয়টি উত্থাপনের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, অবশ্যই আমরা কঠোরভাবে এই নির্যাতনের নিন্দা করি এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা চাইব।
এই বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা হওয়া উচিত সর্বাধিক অগ্রগন্য। কিন্তু কী দেখছি আমরা ? লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বর্মী (রোহিঙ্গা) যখন অস্তিত্ত্ব সংকটে তখন খুনী অং সান সূ চী’র বার্মাকে আপোষ-রফা মূলক শীতল প্রস্তাব দান মগ নেত্রীকে আরও দুঃসাহসী ও রোহিঙ্গা হননে উৎসাহী করে তুলেছে। দু’পক্ষের মধ্যে যখন সংঘাত লেগে যায় তখন একপক্ষকে দুর্বল প্রতিভাত হলে অপর পক্ষ আরো দুর্দান্ত হয় এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে নিঃশেষ করে দেয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ওয়ে অব ডিফেন্স। মহাতœা ঈশপের অমর বাণী উদ্ধৃত করে শেষ করছি। এক বিষধর সাপ কাউকে দংশন করবে না বলে দেবতা জিউসকে প্রতিশ্রুতি দেয়। এখন দেখা যায়, একেবারে ইতর নগণ্য জীবটিও তাকে মাড়িয়ে যায়, পাত্তা দেয় না। এ বিষয়ে সে দেবতা জিউসের কাছে গিয়ে নালিশ করায় দেবতা তাকে বললেন, তোমাকে তো কেবল ছোবল মারতে নিষেধ করেছি। তুমি কি ফোঁশও করতে পার না ?
সেল : ০১৮৬৯ ৮৬৬৯০০ তারিখ : ০৬.০৯.২০১৭ বুধবার কক্সবাজার
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।