এস, এম, মহিউদ্দীন (মুকুল)
ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকান বলতে বোঝাত মিয়ানমার, অর্থাৎ বার্মার একটি বিভাগকে। এতে ছিল চারটি জেলা। এগুলো হলো : ১. পার্বত্য আরাকান (Arakan Hill Tracts), ২. আকিয়াব (Akyab), ৩. সান্ডোয়ে (Sandoway) এবং ৪. কাউকপিউ (KyaukPyw)। পার্বত্য আরাকান জেলাকে এখন সাবেক আরাকান থেকে পৃথক করে জুড়ে দেয়া হয়েছে বার্মার আর একটি স্বায়ত্তশাসিত অঙ্গরাষ্ট্র চীন (Chin State) রাজ্যের সঙ্গে। মহাচীনের কোনো যোগাযোগ নেই এর সাথে। এটা হলো বার্মার একটি প্রদেশ। এখানে বাস করে একাধিক উপজাতি। যার মধ্যে প্রধান হলো চীন। বার্মার এই অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে লাগোয়া হলো বাংলাদেশের বান্দরবান জেলা। এখানে বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে সীমানা খুব সুচিহ্নিত নয়। তাই ভবিষ্যতে এই অঞ্চল নিয়েও বার্মার সাথে বাংলাদেশের বিরোধ দেখা দিতে পারে। বর্তমানে আরাকানকে বলা হচ্ছে ‘রাখাইন প্রে’। এর ভৌগোলিক অবস্থান হলো ১৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট উত্তর ও ২১ ডিগ্রি ৩০ মিনিট উত্তর অক্ষাংশের এবং ৩২ ডিগ্রি ১০ মিনিট পূর্ব ও ৯৪ ডিগ্রি ৫০ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে। বর্তমানে আরাকান হলো পাঁচটি জেলায় বিভক্ত। এগুলোা হলো : ১. সিত্তুই (আয়তন ১২৫০৪ ব.কি., জনসংখ্যা ১০৯৯৫৬৮)। আগে এর নাম ছিল আকিয়াব। সিত্তুই একটি শহরেরও নাম, যা হলো বর্তমান আরাকানের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এখানে স্থাপিত হয়েছে আরাকানের সবচেয়ে বড় সমরঘাঁটি। এখানে স্থাপিত রাডার দিয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা সেনাঘাঁটি পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা যায়। ২. ম্রাউক-উ, যা সম্প্রতি সিত্তুই জেলা থেকে পৃথক করে গঠন করা হয়েছে। ৩ মংডু (আয়তন ৩৫৩৮ ব. কি., জনসংখ্যা ৭৬৩৮৪৪ জন)। ৪. কাউকপিউ (৯৯৮৪ ব.কি., জনসংখ্যা ৪৫৮২৪৪ জন)। ৫. থানদু (১০৭৫৩ ব. কি., জনসংখ্যা ২৯৬৭৩৬ জন)। এখনকার আরাকানের বা রাখাইনের মোট আয়তন হলো ৩৬৭৭৮ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২৯১৫০০০। আরাকান নামটা পালি ভাষার। আমাদের দেশে অনেক অঞ্চলে মানুষ যেমন রাজকে আজ বলে। বর্মি ভাষায় এবং আরাকানি ভাষায় অনেক জায়গায় র কে অ উচ্চারণ করা হয়। আবার অ কে র উচ্চারণ করা হয়। তাই আরাকান এখন উচ্চারিত হচ্ছে আখাইনভাবে। পালি ভাষায় রাক্ষস হলো রাক্ষক। আরাকান বলতে তাই একসময় বুঝিয়েছে রাক্ষসদের দেশ। দেশটির নাম ফারসিতে দাঁড়ায় আরাখন। তা থেকে ইংরেজি ভাষায় দাঁড়ায় আরাকান।
আরাকানের সঙ্গে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলা লাগোয়া। ‘রোহিঙ্গা’ নামটার একটু বিশেষ ইতিহাস আছে। আরাকানের একজন রাজা ছিলেন, যার নাম ছিল মেং সোআ-মউন। তার সাথে বার্মার আভার রাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মেং সোআ-মউন পালিয়ে আসেন গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহাম্মদ শাহর কাছে। জালাল-উদ-দীন তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন যুদ্ধ জয় করে তার হৃত রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। কিন্তু ওই সেনাবাহিনীর অধিনায়ক তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ফলে তিনি যুদ্ধে হেরে বন্দী হন আভার রাজার হাতে। তবে তিনি অনেক কষ্টে বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে আবার গৌড়ে আসতে সক্ষম হন। গৌড়ের সুলতান এবার তাকে আরো সৈন্য প্রদান করেন। ওই বাহিনী পরিচালনার জন্য প্রদান করেন একজন খুবই দক্ষ সেনাপতি। মেং সোআ-মউন এবার আভার রাজাকে পরাজিত করে তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। তিনি আরাকান রাজ্যে একটি নতুন রাজধানী শহর গড়েন, যার নাম দেন রোহং। গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যরা মেং সোআ-মউনর অনুরোধে থেকে যান রোহং শহরে। এদের বংশধরদের বলা হতে থাকে রোহিঙ্গা মুসলমান। রোহিঙ্গারা জোর করে আরাকানে যাননি। বর্তমান রোহিঙ্গারা রোহং শহরে গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যদের বংশধর। সৈন্যরা বিবাহ করেছিলেন স্থানীয় কন্যাদের। তাই প্রকৃত রোহিঙ্গাদের চেহারায় থাকতে দেখা যায় আরাকানের স্থানীয় অধিবাসীদের চেহারার ছাপ। অর্থাৎ মঙ্গোলীয় প্রভাব।
গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ-দীনের জীবন খুবই বিচিত্র। ইনি ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র। তার আদি নাম ছিল যদু। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জালাল-উদ-দীন নাম ধারণ করে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি গৌড়ের সিংহাসনে দুইবার আরোহণ করেন। তার দ্বিতীয়বার রাজত্বকালে (১৪১৪-১৪২৩ খ্রি.) মেং সোআ-মউন আসেন গৌড়ে। রাজা গণেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। সাধারণভাবে বলা হয়, তিনি ছিলেন বর্তমান রাজশাহী অঞ্চলের ভাতুরিয়ার একজন ক্ষমতাশালী সামন্ত। তিনি গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু তার পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালাল-উদ-দীন নাম ধারণ করেন। গড়ে তোলেন এক বিরাট সাম্রাজ্য, যা ছিল চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আরাকানের রাজা তাই সহজেই পালিয়ে এসে আশ্রয় পেতে পেরেছিলেন তার কাছে। জালাল-উদ-দীন খুব ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন। তার সময়ে বহু সম্ভ্রান্ত হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেন। হতে পারে আরাকানের রাজাও তার কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কেননা, মেং সোআ-মউন যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন তার বহু রাজারই থাকতে দেখা যায় দু’টি করে নাম। একটি নাম আরাকানি, আর একটি নাম গৌড়ের সুলতানদের মতো আরবি-ফারসি। আরাকানের এসব রাজা সিংহাসনে আরোহণের সময় মুসলিম নাম গ্রহণ করতেন। আরাকানের শেষ রাজা, যার মুসলিম নাম থাকতে দেখা যায়, তার আরাকানি নাম হলো মিন-থামা-উংলা। আর মুসলিম নাম হলো হুসেন শাহ্্ (১৬১২-১৬২২ খ্রি.)। এসব আরাকানি রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রার একপিঠে আরবি-ফারসি অক্ষরে লেখা থাকতে দেখা যায় তাদের মুসলিম নাম। এমনকি এদের মধ্যে তিনজন রাজার মুদ্রার ওপর কালেমায়ে ত্যইয়িবা লেখা থাকতে দেখা যায়। এসব মুদ্রা রক্ষিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। আরাকানে হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে বাংলাভাষী মুসলমান গিয়েছেনÑ এ রকম বলা নিতান্তই ভুল। সমস্ত আরাকানের উত্তরভাগে চলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা ভাষা। বৌদ্ধ আরাকানিরা এই ভাষা বোঝেন এবং বলেন। বর্মা বা ব্রহ্মদেশ ছিল ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর একটি দেশে পরিণত করা হয় একে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ গিয়েছে আরাকানে। তখন এই ক্ষেত্রে কোনো বাধাই ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে সহজেই গিয়েছে আরাকানে। তারা আরাকানে ক্ষেত-খামার করেছে। আরাকানের অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়। এর পরে সৃষ্টি হতে পারে আরাকানে রোহিঙ্গা সমস্যা। এই সমস্যা সৃষ্টির মূলে আছে বিশেষভাবে বার্মার থেরবাদি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ। ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে বার্মা একটি বিরাট দেশ। কিন্তু সে তুলনায় জনসংখ্যা বেশি নয়। বার্মার বহু জায়গাই অনাবাদি পড়ে থাকে জনশক্তির অভাবে। বার্মা সরকার ইচ্ছা করলে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি গ্রহণ করে করতে পারে এসব জমিতে চাষাবাদ। কিন্তু তা না করে চাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি করতে। ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা থেকে অনেকে আসতেন রংপুরে। রংপুর থেকে তারা তামাক কিনে নিয়ে যেতেন বার্মায়। বার্মায় তৈরি হতো রংপুরের তামাক পাতা দিয়ে বিখ্যাত বর্মি চুরুট। বার্মার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনোই এতটা বৈরী হয়ে ওঠেনি। পালি ভাষায় যে দেশটাকে বলা হতো ব্রহ্মদেশ, ফারসিতে তার দাম দাঁড়ায় বারহামা। ফারসি বারহামা নাম থেকে এসেছে ইংরেজি ‘বার্মা’ নামটি। বার্মা এখন নিজেকে বলেছে মিয়ানমার। কেননা, যাদের আমরা বলি বর্মি, তারা তাদের নিজেদের ভাষায় বলেন ম্রনমা। শব্দগত অর্থে ম্রনমা মানে হলো, মানুষ। কিন্তু মিয়ানমারে শুধু যে ম্রনমারা বাস করেন তা নয়, সেখানে বাস করেন কারেন, কাচিন, শান, মন প্রভৃতি জাতি। তারা হতে চাচ্ছেন স্বাধীন। বার্মায় গৃহযুদ্ধ চলেছে বহু দিন ধরে। বার্মা যদি চায় রোহিঙ্গা সমস্যা বাড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করে বর্মি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে, তবে বার্মার ভেতরে বিভিন্ন জাতিসত্তার সঙ্ঘাত আরো বেড়ে উঠতেই পারে।
আমরা বাইরের লোক। বাংলাদেশ সরকারের নীতির কথা আমরা জানি না। তবে পত্রপত্রিকার খবর পড়ে এবং বিদেশী টেলিভিশনের মাধ্যমে খবর দেখে মনে হচ্ছে, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে বিরাজ করছে যুদ্ধাবস্থা। এমতাবস্থায় মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশের উচিত হবে সৈন্য সমাবেশ এবং সামরিক মহড়া প্রদর্শন। শুধু বিজিবির হাতে সীমান্ত রক্ষার ভার ছেড়ে রাখা উচিত হবে না।
লেখক : এস, এম, মহিউদ্দীন (মুকুল) সম্পাদক নাইক্ষ্যংছড়ী নিউজ ডটকমঃ
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।