মু. ইসলাম

রোহিঙ্গা ইস্যুটি নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক পুরনো একটি সমস্যা। সমস্যাটি ১৯৪৭ সালেই শেষ হতে পারত, হয়নি শুধুমাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একঘেয়েমি ও অদূরদর্শিতার কারণে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে আরাকান মিয়ানমার হতে আলাদ হতে চেয়েছিল। নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে ১৯৪৬ সালে তারা আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে কিন্তু জিন্নাহ মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জিন্নাহ তথা মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণেই মূলত রোহিঙ্গা মুসলিমরা আজও নির্যাতিত।
“It’s your world” মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৪৫ সালে গঠিত হয় জাতিসংঘ যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারষ্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা
‘মানবিকতা রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ বা আরটুপি (R2P-Responsibility to Protect) তত্ত্বটি জাতিসংঘ কর্তৃক উদ্ভাবিত ও অনুমোদিত। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব সম্মেলনে এ তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়।
আরটুপির ১৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার জনগণকে সব ধরনের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান থেকে রক্ষা করবে। এ ধরনের অপরাধ যাতে না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই দায়িত্ব পালন করতে ওই রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে।”
১৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতিসংঘের মাধ্যমে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান, মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে কুটনৈতিক, মানবিক উদ্যোগসহ প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে।”
এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিরীহ জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করা এবং তাদের মানবাধিকার নিশ্চত করা। যেমনটি ঘটেছে লিবিয়া, সিরিয়া, সুদান ও কেনিয়ায়। যে প্রক্রিয়ায় এসব দেশে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল তা অনুসরণ করা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ -পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমারে-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করা, লাশ গুম ও সাগরে ভাসিয়ে দেয়া, ধর্ষণ ও অঙ্গহানিসহ নানা কায়দায় লোমহর্ষক বর্বরতা যাকে বিশ্ববিবেক গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। আজ মিয়ানমারে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে খোদ জাতিসংঘ একে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা জেইদ রা’দ আল হোসেইন জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া ভাষণে রোহিঙ্গা হত্যাকান্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন “এই পাশবিকতার ঘটনা পাঠ্যপুস্তকের জন্য ‘জাতিগত নির্মূলের’ একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।” গণহত্যার জন্যে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বসির, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরও এই বিচার এড়াতে পারেনি। বর্তমানে বিশ্বে ৫৮টি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫টি দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন কাজ করছে।
কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃক পরিচালিত (জাপানের ন্যায় ত্রি অল পলিসি-হত্যা কর, জ্বালিয়ে দাও এবং ধ্বংস কর) রোহিঙ্গা হত্যাকান্ড গণহত্যা হিসেবে উত্থাপিত হওয়ার পরও কেন আরটুপি এপ্লাই করা হচ্ছে না বিশ্ববাসীর কাছে তা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ভারত-চীনের হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ, চীন-রাশিয়ার মিত্রতা, তোষামোদে ইত্যাদির করাল গ্রাসে মানবতা আজ লজ্জিত। ভূ-রাজনীতি তাদেরকে নির্লজ্জ বানিয়েছে। ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যায় (উত্তরবঙ্গের ১৮টি জেলা) নিমজ্জিত বাংলাদেশ এবং নানা সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ইতোমধ্যে যা করেছে বিশ্ব আজ অবাক, বিস্মিত। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে গণপ্রজাতন্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা হয়েছেন বিশ্ব নন্দিত, পেয়েছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি উপাধি’ এবং জাতিসংঘের চলতি ৭২তম অধিবেশনে হয়েছেন সকলের মধ্যমণি। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলিষ্ঠ কন্ঠে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গার উপর চলমান নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার ও গণহত্যার প্রসঙ্গটি। অভিন্ন পথ থেকে সরে আসার জন্যে আহ্বান করেছেন ফ্যাসিস্ট ও সাম্রাজ্যবাদীদের। মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা এই ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের অবসান দেখতে চাই। আমাদের মুসলমান ভাইদের এই দুর্দশার অবসান চাই। এই সঙ্কটের সূচনা হয়েছে মিয়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান হতে হবে।” রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে নির্যাতন বন্ধ করে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের জাতীয়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অপপ্রচার বন্ধ করাসহ ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরেও যদি হৃদয়ঙ্গম না হয়, জাতিসংঘ কেন আরটুপি এপ্লাই করবে না? আরটুপি তত্ত্ব কি মিয়ানমারের জন্যে প্রযোজ্য নয়?