গোলাম আজম খান:
নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের মুখে খাকি পোশাক, বুট জুতা আর অস্ত্রধারী মিয়ানমার মিলিটারির (রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীকে মিলিটারি বলে জানে) নৃশংসতার বর্ণনা শুনে সবাই কেঁদেছে। অপরদিকে সরকারি আদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শনিবার সকালে পৌঁছে কুতুপালং ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। কাঠফাঁটা রোদে পলিথিনের ঝুপড়িতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন সবাইকে ব্যথিত করেছে।
পোশাকি মিল থাকলেও প্রত্যেক দেশের সেনাবাহিনী যে একই চরিত্রের নয়, তা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অমানবিক বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার মানুষগুলো এখন দেখছে অন্য এক রকম সেনাবাহিনী।
শনিবার হঠাৎ সেনা সদস্যরা শরণার্থী শিবিরে ঝুপড়িগুলো পরিদর্শন করার সময় অনেক রোহিঙ্গা নারী ও শিশু ভয় পেয়ে যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্মমতার স্মৃতি তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে ভয় পেয়েছে তারা। অবশ্য বাংলাদেশ সেনা সদস্যদের ভালোবাসা ও সুন্দর করে কথা বলা দেখে ভুল ভাঙে রোহিঙ্গাদের। খাকি পোশাক, পায়ে বুট জুতা, আর কাঁধে ঝুলানো অস্ত্র থাকলেই যে নির্যাতন করবে এমন চিন্তাধারার পরিবর্তন এসেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে । শনিবার থেকে সেনাবাহিনীর সমাদর, সহযোগিতা ও ভালোবাসা দেখে আপ্লুত তারা। কেউ কেউ বলছেন এই মিলিটারি সেই মিলিটারি না।
নিজ দেশে বাস্তুুুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার উখিয়ায় যে ২ হাজার একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে সেনাবাহিনী ১৪ হাজার শেড তৈরি করবে। এসব শেডের প্রতিটিতে ছয়জন করে ৮৪ হাজার পরিবারকে বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হবে। শেড নির্মাণের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সেনাবাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা এটি করছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে চলমান প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর কোথায় কি করতে হবে তা নির্ধারণ করে তারা ফিরে যান। শনিবার দুপুরে ৩৬ বীর, ২৪ বেঙ্গল ও ৬৩ বেঙ্গল নামে তিনটি টিম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় স্থল উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী আসে।
সেনাদের ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার এসপি জানান, পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এসে সেনা সদস্যরা প্রথমে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ শুরু করে। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বিচ্ছিন্ন ত্রাণ বিতরণ এবং রাস্তায় রোহিঙ্গাদের অহেতুক জটলা সরিয়ে দিয়ে সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘ্ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কন্ট্রোল রুমে জমা হওয়া দ্রুত পচনযোগ্য তাজা খাবারগুলো আলাদা করে বিতরণের জন্য নেয়া হচ্ছে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আসা রোহিঙ্গারাই এসব ত্রাণের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিকের সুবিধার মেসেজটা রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। যাতে কচ্ছপ গতি থেকে চলমান এ নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা খরগোশ গতিতে আসে।
কাজের সুবিধার্থে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিত্যক্ত একটি কক্ষকে কোম্পানির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার জানান, প্রথম দিন হিসেবে শুধু শৃঙ্খলা আনয়নে কাজ করেছি। রোববার থেকে একটি টিম শেড নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে ঢোকে রোহিঙ্গারা। মানবিকতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়ে সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। শুধু ত্রাণ দিলে হবে না তাদের জন্য সুষ্ঠু স্যানিটেশন ব্যাবস্থা, সুপেয় পানিসহ পরিচ্ছন্ন আবাসন দরকার। তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হবে। এটি স্থানীয়দের জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই দ্রুততার সঙ্গে শৃঙ্খলভাবে কাজ সম্পন্ন করতে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছি।
জেলা প্রশাসক জানান, সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিককরণে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার কাজ করবে। পাশাপাশি শৃঙ্খলার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণেও কাজ করবে সেনাবাহিনী। এ কারণে সব ধরনের ত্রাণ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রদানের জন্য আবারও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।