সিবিএন ডেস্ক:
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার। দখলকৃত গ্রামগুলোকে ঘিরে পুনঃউন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইট টাইমস জানিয়েছে, সরকারের তত্ত্বাবধানেই গ্রামগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হবে। সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে তারা জানিয়েছে, সেখানকার পুনঃউন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ‘বেশ কার্যকর’ হবে। বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের নেপথ্যে সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনাকে প্রধানতম কারণ বলে মনে করছেন।

 

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির সামাজিক উন্নয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে আগুনে পুড়ে ফাঁকা হয়ে যাওয়া ভূমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাখাইনের সিত্তেতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী, পুড়ে যাওয়া ভূমি সরকারি ব্যবস্থাধীন ভূমিতে পরিণত হয়।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি আইনকে উদ্ধৃত করে উইন মিয়াত বলেন, পুনঃউন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ‘বেশ কার্যকর’ হবে। সংঘাতসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পুনর্গঠনের কাজ সরকারের তত্ত্বাবধানে করার কথা ওই আইনে বলা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই অধিগ্রহণ পরিকল্পনার বিস্তারিত জানানো হয়নি। পুনর্গঠনকৃত গ্রামগুলোতে পুরনো রোহিঙ্গা বাসিন্দারা ফেরত আসলে তাদেরকে কী সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে তাও উল্লেখ করা হয়নি। এ ব্যাপারে জানার জন্য মিয়ানমারের পুনর্বাসনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ‘এক্সপালসন্স: ব্রুটালিটি অ্যান্ড কমপ্লেক্সিটি ইন দ্য গ্লোবাল ইকনোমি’ বইয়ের লেখক সাসকিয়া সাসেন। রোহিঙ্গা সংকটের কারণ হিসেবে বড় ধরনের সরকারি ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সামনে এনেছেন তিনি। বলছেন, এ ক্ষেত্রে চীনের বৈশ্বিক ও কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। এর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও ব্যাপক আকারে ভূমি দখল ও উচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল মিয়ানমার টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সেনাবাহিনীর দখল করা ভূমি থেকে লাভবান হচ্ছে হিলটন ও ম্যাক্স হোটেলের মতো বিলাসবহুল হোটেল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাখাইনে ১৯৯৬ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৫৫নং ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের দখল করা ৩৫.৫ একর কৃষি জমির ওপর চারটি বিলাসবহুল হোটেল গড়ে উঠেছে। ওই ভূমির মূল্য কোটি টাকার বেশি। অথচ জমির মালিকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, উপকূলের নিরাপত্তার স্বার্থে এসব ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের ৪০০রও বেশি রোহিঙ্গা গ্রামের প্রায় অর্ধেকই সাম্প্রতিক সংঘাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন, তাদের কে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। মিয়ানমার সরকারের হিসেব অনুযায়ী, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর প্রায় অর্ধেকই পরিত্যক্ত। মিয়ানমার সরকারের দাবি, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বেসামরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে ও গুলি করেছে।

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর চলতি সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে উল্লেখ করেছে। তবে এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুরুতরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন চালিয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রগুলো হলো: ক) কোনও জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা, খ) হত্যা, গ) ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সন্ত্রাস এবং ঘ) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাচুর বিবেচনায় নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড করা।