আব্দুল্লাহ আল মামুন :

ক’দিন আগে আমার অফিসের একজন মহিলা স্থপতি সহকর্মী  বাংলাদেশে যাবার জন্য ভালো এয়ারলাইন্স কোনটি তা জানতে চাইলেন। তিনি হলেন ভারতের কেরালা প্রদেশের।  বাংলাদেশের কোথায় বেড়াতে যাবে জানতে চাইলে ও বললো, “বেড়াতে নয়!  আমার স্বামী রোহিঙ্গাদের  জন্য ত্রান নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে। ওর সাথে দুবাই থেকে আরো পঞ্চাশ জন স্বোসচ্ছাসেবীও যাচ্ছে।”  শুনে উজ্জ্বীবিত হলাম। এতোদিন যা ভাবছিলাম তা নয়। বিশ্ব বিবেক চুপ করে বসে নেই।  রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার বিশে^র দেশে দেশে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আলোড়িত করছে তাদের মানবিক সত্ত্বাকে। তাইতো আমার সহকর্মীর স্বামীর মতো অসংখ্য মানুষ সাহায্য  ও সহানুভ’তির ডালা নিছে ছুটে যাচ্ছেন নাফ নদীর প্রান্তরে এইসব হতভাগ্য মানুষের কাছে । জানতে পারলাম, এরকম আরো বহু দল বিপন্ন  মানবতার আর্তনাদে সাড়া দিয়ে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যাচ্ছেন বাংলাদেশে।

 

শতাব্দীর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গা জনগন। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছেনা এই নিষ্ঠুরতা থেকে। তাদের অপরাধ তারা রোহিঙ্গা মায়ের সন্তান। আমার দেশের বাড়ী কক্সবাজার হবার সুবাদে ছোটোবেলা থেকেই অনেক বার্মিজদের চিনতাম। এরা কক্সবাজারে মূলতঃ বার্মিজ দোকান চালাতো। যদিও স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যসায়ীরাও এখন এই ব্যবসায়ে সফল হচ্ছে।  বার্মিজদের আমরা স্থানীয় ভাষায় মগ বলে ডাকতাম।

 

ছোটোবেলায় বড়দের সাথে প্রায়ই কক্সবাজারের বৌদ্ধমন্দিরে বেড়াতে যেতাম। বৌদ্ধমন্দিরকে স্থানীয় ভাষায় আমরা কিয়্যাং আর মন্দিরের পুরোহিতকে “ঠউর” বা ঠাকুর বলে ডাকতাম। বৌদ্ধমন্দিরের ভেতরে তমসাচ্ছন্ন কক্ষে রাখা বিশাল বুদ্ধ মূর্তি আমাকে ভীষণ টানতো। কিছুটা ভীতি এবং এক অজানা আকর্ষনে যখন মঠে যেতাম তখন মনে হতো দাদুর মুখে শোনা সেই কামরূপ-কামোক্ষ্যার মায়াবী রাজ্যে এসে পৌচেছি। ওই সময় বাড়ীর মেয়েদের অনেকেই  বার্মিজদের অনুকরণে ত্বককে মসৃন রাখার জন্য মুখে চন্দনের প্রলেপ দিতেন। ওদের কাছে বার্মিজ দোকান ও বৌদ্ধ মঠের প্রধান আকর্ষণ ছিল সুগন্ধযুক্ত চন্দন কাঠ। বৌদ্ধ মঠে গেলে গেরুয়া বসন পরিহিত পুরোহিত হাসিমুখে স্বাগত জানাতেন আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্থানীয় ভাষায় কুশলাদি বিনময় করতেন।

 

একবার বড় আপুর সাথে বৌদ্ধমন্দিরে গিয়েছিলাম । আমাদের দেখে বৌদ্ধ পুরাহিত উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। পুরোহিতের মুখেও দেখলাম চন্দনের প্রলেপ। আপু ঠাকুরের কাছে একটি চন্দন কাঠের টুকরো চাইলেন। ঠাকুর হাসিমুখে ভেতরে থেকে এক খন্ড চন্দন আপুর হাতে তুলে দিলেন। আপুতো মহাখুশী। একদম খাঁটি, বার্মা থেকে আনা। শুনেছি ওই পুরোহিত নাকি ভবিষ্যতবাণীও করতে পারতেন। নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে অবশেষে আপুকে অনুরোধ করলাম ঠাকুরকে বলে আমার হাত দেখে দিতে।  পুরোহিত মহাশয় হাত দেখে আমাকে বললেন, “তুমি পড়াশুনায় ফাঁকি তাও, তাইনা ?” আমি রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।  মনে মনে বললাম, “ব্যাটা বলে কি রে? ক্লাসের ফার্ষ্টবয় যদি ফাঁকি দেয় তাহলে পড়াশুনা করবে কে?” এতো কাছ থেকে দেখা মানুষগুলো এভাবে যে দানব হয়ে যাবে তা মেনে নিতে পারছিলাম না।

 

মুসলিম ধর্মের অনুসারী বলে রোহিঙ্গাদের যেভাবে নিধন করা হচ্ছে তা কখনোই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। কোন দেশের নাগরিক কিংবা কি তাদের ধর্ম, সেটা কি বড় কথা?  রোহিঙ্গাদের আসল পরিচয় হচ্ছে, ওরাও মানুষ।  মানবতার এই চরম বিপর্যয়ে কি  চুপ করে থাকা যায়? রোহিঙ্গাদের ভাগ্য মুহূর্তের মধ্যে হয়তো আমরা বদলে দিতে পারবোনা। কিন্তু  আমরা যে যেখানে আছি, সেখানে দাঁড়িয়েই বিপন্ন মানবতার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।  সেই উপলব্ধি থেকেই হঠাৎ করে সেদিন একটি গান লিখলাম। যার শিরোনাম হচ্ছে “হৃদয়ের কাছে”।  গত বছর অডিও এলবাম “তোমার জন্য” প্রকাশনার পর এটা হল আমার প্রথম কম্পোজিশন। রোহিঙ্গাদের জন্য মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্যই এই গান। গানের সুর করার সময় আমার বড় মেয়ে পেশায় আইনজীবি মুনিরা গীটার হাতে তুলে নিয়ে বললো, “বাবা, আমিও তোমার সাথে কাজ করবো”।

 

গান লিখা ও সুর দেয়াতো হলো কিন্তু মিউজিক কম্পোজিশান এবং রেকর্ডিং করবো কোথায়? প্রবাসে এ ধরনের কাজ করাটা খুব সহজসাধ্য নয়। জীবন ও জীবিকার জন্য সবাইকে এতোটই ব্যস্ত থাকতে হয় য়ে, অন্য কিছুর দিকে ধ্যান দেবারই ফুরসত থাকেনা। ফলে প্রবাসে চর্চার অভাবে অনেক ভালো ভালো মিউজিশিয়ানদেরও নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখেছি। কাতারের কয়েকজন সঙ্গীতপ্রেমী বাংলাদেশি যুবকের ব্যান্ড হচ্ছে “শ্রাবন”।  ওদেরকে আমার গানের কথা বলতেই সবাই বললো, “এ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা, আমরাই মিউজিক করবো”। এখনতো আর আগের মতো ক্যাসেট ও সিডির যুগ নেই। ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে গান প্রকাশ করতে হয়ে।  তাই গানের সাথে সাথে চাই মিউজিক ভিডিও। অনেক প্রকিতক’লতার মধ্যেও গানের কাজ এগিয়ে চলেছে, খুব সহসা আমার কন্ঠে এই গান আমার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।

 

বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য এই স্বরণার্থীর ভীড় একটি বাড়তি চাপ। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আগত শরনার্থীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশী। এই সংখ্যা অচিরেই ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।  এতোগুলো মানুষের খাবার-দাবার, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ এবং অভিজ্ঞ জনবল। বিদেশী সাহায্য  যা আসছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। মিয়ানমারের সরকারী জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশেকে আরো সরব হতে হবে বিশ^ মঞ্চে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও যাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সেজন্য জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে প্র্রধানমন্ত্রী একবার মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে যেতে পারেন।

 

সমগ্র বাংলাদেশ, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগন যেভাবে রোহিঙ্গা শরনার্থীর সাহায্যে যেবাবে এগিয়ে এসছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর! কিন্তু এই আবেগ যাতে ঘৃনা কিংবা সহিংসতায় রুপ না নেয় সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।  রোহিঙ্গাদেও অধিকার আদায়ের জন্য অনেকে সোস্যাল মিডিয়াতে জিহাদ কিংবা লড়াই শুরু করারও আহ্বান জানাচ্ছেন।  এই ধরনের প্রস্তাব খুবই বিপদজনক এবং আত্মঘাাতিমূলক, যা দেশের জন্য  সর্বনাশা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আমরা রোহিঙ্গাদের সাহায্য ও পূনর্বাসনের জণ্য সব উজাড় করে দিতে পারি কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতে যাতে কোনো ধরনের সন্ত্রাশী কার্যকলাপ যাতে চলতে না পারে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। এই ধরনের আবেগ তাড়িত কাজ রোহিঙ্গাদের মুক্তিকে করবে সুদূর পরাহত আর আমাদেরকেও  ভয়ংকর পরিনামের দিকে ঠেলে দিতে পারে ।