অধ্যাপক ড. মোঃ নুরুল আবছার :
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (দূরভিসন্ধিমূলক ভাবে যাকে বর্তমানে রাখাইন স্টেট নামকরণ করা হয়েছে) রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত জাতিগত নিধনযজ্ঞ, বর্বরোচিত গণহত্যা, গণধর্ষণ, হেলিকপ্টার থেকে গান পাউডার ছিটিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়াসহ ইত্যাদি অমানুষিক নির্যাতন বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। যে গণহত্যা ও অমানুষিক নির্যাতন থেকে নারী-শিশু, আবল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউই রেহাই পাচ্ছেনা। যেখানে মানুষকে গুলি করে জবাই করে, নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে তাদের লাশসমূহ টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। একটি নিরস্ত্রও বেসামরিক জাতি গোষ্ঠীকে তাদেরই সরকার ও সরকারের বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক নিধন ও নির্মূলকরণের দৃষ্টান্ত যেমন রোহিঙ্গা ছাড়া দ্বিতীয়টি নেই, আবার সেই নির্মূলকরণের ধরণও বহুবিচিত্র ও লোমহর্ষক। আগষ্টের ২৫ তারিখ থেকে অদ্যাবধি পুরো ১৮ হাজার বর্গমাইলের রোহিঙ্গা জনপদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ম্যাসাকার করে দিচ্ছে, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-যুবা নির্বিশেষে কেটে কেটে পুরো বসতিকে শ্মশানে পরিণত করছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করে এটিকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও স্থানীয় রাখাইন-বুড্ডিষ্টদের নিয়ে গড়ে তোলা বিশেষ বাহিনী রাতের আঁধারে আচমকা এসে মুসলমান পাড়ার ঘরগুলো ঘিরে ফিলে এবং দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। তারপর ঘরগুলো চারিদিকে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘুমন্ত মানুষগুলো আপনঘরেই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। এইভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জানিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ২৪০টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা যুগের পর যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরাকান রাজ্যে বসবাস করে আসছে। একসময় আরাকান স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। মহাকবি আলাউলসহ অসংখ্য মুসলিম কবি আরাকান রাজ সভার কবি ছিলেন। পরবর্তীতে বার্মিজরা আরাকান দখল করে নেয়। তারপরেও আরাকানে মুসলিমদের নাগরিকত্ব ছিল, ভোটাধিকার ছিল এবং তাদের ভোটে ৪/৫ জন মুসলিম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আরাকান রাজ্যে মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার বাতিল করা হয়। শিক্ষা-চিকিৎসাসহ যাবতীয় মৌলিক মানবাধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয় এবং দূরভিসন্ধিমূলক ভাবে আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন স্টেট নামকরণ করা হয়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ক্রমান্বয়ে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক তাদের ভিটে-মাটি থেকে বিতাড়িত করে তাদের বাঙ্গালি (কল্পিত) আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে রাখাইন স্টেট কে মুসলিম শূন্য করার ভয়ষ্কর নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে আরাকানের সামরিক জান্তা, স্থানীয় উগ্রসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী এবং বিশ্ব মোড়লদের সাম্প্রদায়িক, ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক হীন স্বার্থ চারিতার্থ করার ঘৃণ্য মানসিকতা।
বিশ্বের প্রত্যেক ধর্ম প্রচারক, প্রফেট ও অবতারদের প্রচারিত ধর্মের মূল মর্মবাণী ছিল মানবপ্রেম, মানবকল্যাণ, জীবপ্রেম, অহিংসা, পরমত সহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, প্রত্যেকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা। বড়– চন্দিদাশের চিরন্তন বাণী আজ কতইনা প্রাসঙ্গিকঃ‘ শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মহামতি গৌতমবুদ্ধ যখন বনে-জঙ্গলে পায়চারী করতেন তখন তিনি তার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে ঝরা পাতাগুলো সরিয়ে দিতেন। যাতে পাতার নিচে থাকা কীট-পতঙ্গ তার পায়ের চাপায় মারা না যায়। যেহেতু তার মতে: ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এবং তিনি প্রাণীকুলের সুখ কামনা করতেন। মহাত্মা গান্ধীর মতে; অহিংসা পরম ধর্ম, স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন; জীবে প্রেম করে যে জন সে জন সেজন সেবিছে ঈশ্বর’ অর্থাৎ জীব সেবা ঈশ্বর সেবা। মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স:) ৬২৪ খ্রি: মদীনার সকল গোত্র ও সম্প্রদায়ের নেতাদের নিয়ে একটি অপূর্ব সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন। যাকে মদীনা সনদ নামে পৃথিবীবাসী আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাতে উল্লেখিত হয়েছে: ১। মদীনা সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদী, খ্রষ্টান সম্প্রদায়সমূহের সকলে সমান অধিকার ভোগ করবে। ২। মুসলমান এবং অমুসলমান পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীন বজায় রাখবে। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা বিনা দ্বিধায় নিজনিজ ধর্ম পালন করবে এবং কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবেনা। ৩। ইহুদীদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে মহানবী (স:) ৫ বছর মেয়াদী ‘হরব আল-ফুজার’ এর বিভৎসতা ও নিষ্ঠুরতায় ব্যথিত হয়ে ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নিঃস্বার্থ, উদারপন্থী ও উৎসাহী আরব যুবকদের সমন্বয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে একটি শান্তি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। হিলফুল ফুযুলের সকল সদস্যই আল্লাহ্ তায়ালার নামে এই প্রতিজ্ঞা করেন:
১। আমরা নিঃস্ব, অসহায় ও দুর্গতদিগকে সেবা করব। ২। আমরা অত্যাচারীকে বাধা দেব। ৩। মাযলুমকে সাহায্য করব। ৪। দেশের শান্তি শৃংখলা রক্ষা করব। ৫। বিভিন্ন গোত্রের মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন করব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি তাদের এদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন: ‘প্রয়োজনে আমরা না খেয়েও তাদের খাওয়াব, একজন মানুষকেও অনাহারে- বিনা চিকিৎসায় মরতে দেওয়া যাবেনা, যতদিন তারা স্বদেশে ফেরত যেতে পারবেনা ততদিন তারা এখানেই থাকবে। ১৬ কোটি মানুষকে যদি আমরা খাওয়াতে পারি ১০ লক্ষ শরণার্থী আমাদের কাছে কোন ব্যাপার না, প্রয়োজনে আমরা খাবার ভাগ করে খাব’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ মহানুভবতা ও বদান্যতায় মানবতাবাদী বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তিনি পেয়েছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটির’ খ্যাতি। ইউরোপের ৪০টি দেশ যেখানে ৪০ হাজার শরণার্থীর দায়িত্ব নিতে রাজী হয়নি সেখানে ক্ষুদ্রায়তনের এ জনবহুল বাংলাদেশ ১৫ লক্ষাধিক (বেসরকারী হিসাবে) শরণার্থীর ভারবহন করছে। জন প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, সিনিয়র মন্ত্রীবর্গ, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ জেলা ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা নাওয়া-খাওয়া ফেলে শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জাতিগত সমস্যা সমাধানে যে যুগান্তকারী ৫ দফা প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছেন তা বিশ্বসম্প্রদায় কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহ হলো: ১। অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতাও জাতিগত নিধন নি:শর্তে বন্ধ করা। ২। অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা। ৩। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় (ঝধভব তড়হব) গড়ে তোলা। ৪। রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘর-বাড়িতে প্রত্যার্বতন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। ৫। কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তাবয়ন নিশ্চিত করা। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব সমূহ দ্রুত বাস্তাবায়নে দল-মত-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে এবং রোহিঙ্গা বিপন্ন মানবতার জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। শিল্পীর দরদী কণ্ঠে যেভাবে ধ্বনিত হয়েছিলঃ মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনা…………
লেখক: ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ,আওয়ামীলীগ কক্সবাজার জেলা ও সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার সোসাইটি। মোবাইল: ০১৮১২-৬০৯০৯৫।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।