ইতোমধ্যেই হয়ত প্রাণহরি দাসের খবরটি অনেকে পড়েছেন। তারপরেও লেখার শুরুতে বর্ণনা করছি যারা পড়েননি তাদের জন্য। “লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে প্রাণহরি দাস নামের এক অসহায় বৃদ্ধের বয়স্ক ভাতা থেকে কৃষিঋণের টাকা জোরপূর্বক আদায় করার অভিযোগ উঠেছে কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। পাঁচ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধের নামে গত আট বছরে বয়স্ক ভাতা থেকে ২২ হাজার টাকা কেটে নেওয়াহলেও ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পাননি তিনি।” কালের কণ্ঠের সংবাদ। সংবাদ তো সংবাদই, তা নিশ্চয়ই সত্য, আবার অনেক সময় বানানোও হতে পারে, তবে একজন অসহায় বৃদ্ধদের পক্ষ মিথ্যা সংবাদ বানানোর মত লোক এদেশে থাকলে তাতে আমি বরং আশাবাদীই হতাম। খবরটি অনেক পত্রিকায়ই এসেছে। আমার কাছে প্রাণহরি দাস এখানে প্রতিকী। গ্রামে এরকম ‘প্রাণহরি দাস’ অনেক আছে যারা কৃষি ব্যাংকের কাছে নাজেহাল হচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে। যে লোন পাওয়া তাদের অধিকার সেটি তারা পাচ্ছে না ঘুষ এবং জামানত দিয়েও। ড. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অনেক সমালোচনার সুযোগ আছে, সমালোচনা হয়েছেও, শুধু সমালোচনা হয়নি, রীতিমত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সঠিক সবকিছুই সুন্দর, তা যার বিরুদ্ধেই যাক না কেন। কিন্তু সরকারি ব্যাংক কৃষি ব্যাংক আসলে কী করছে? সেটি জানানোর আগে আরেকটি খবর শেয়ার করি। আবার আমি যা জানাব সেটি বিশ্বাস করতে হবে এমন কথাও নিশ্চয়ই নয়। সুযোগ থাকলে কেউ একটু জানার চেষ্টা করে দেখতে পারেন এসব, কারণ, শুধু বিশ্বাসে মাঝে মাঝে কিছু বস্তুআচমকা মিললেও সত্য মেলে না সহজে। তবে কৃষি ব্যাংকের বেশিরভাগ চাকুরেদের কাছ থেকে কিছু না জানাই ভালো। কারণ, সোনার খনির সন্ধান পেলে তা কেউ আপনাকে জানিয়ে দেবে না। কৃষি ব্যাংক হয়ত সোনার খনি না, তবে রূপার খনি, এবং সহজে উত্তোলনযোগ্য। অনিশ্চিতসোনার চেয়ে উত্তোলনযোগ্য নিশ্চিত রূপা ভালো। গ্রামের ভুলোভালা অশিক্ষিত, দরিদ্র মানুষকে কব্জা করা তুলনামূলক সহজ, আর কৃষি ব্যাংকের বেশিরভাগ সেবা গ্রহীতা যেহেতু গ্রামের শ্রমিক এবং কৃষককূল, তাই তারা কর্মকর্তা এবং তাদের দালালদের কাছে মায়া হরিণের মত। কর্মকর্তারা শুধু ওৎ পেতে থাকলেই হয়, দায় ঠেকে ওরাআসবে (হরিণ যেমন ক্ষুধায় কাতর হলেও বাঘের ভয় জয় করে চারণ ভূমিতে আসে ঘাস খেতে) কেউ বাঁচবে কোনোমতে, কেউ মরবে, তবে ঠকবে সবাই। “মোল্লাহাটে অক্ষরজ্ঞানহীন এক কৃষাণীকে কৃষি ব্যাংকের লোন দেয়ার নামে চাঞ্চল্যকর প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক মোল্লাহাট শাখার দুর্নীতিবাজ এক কর্মকর্তার অভিনব লোন প্রতারণার শিকার হয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন বিধবা ওই ভূমিহীন কৃষাণী এখন সন্তানদেরনিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। ওই ঘটনায় দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।” -দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার খবর এটি। কষ্ট করে এই খবরটি একটু বিস্তারিত পড়ার অনুরোধ করব। ইতালিক করে দিলাম বিস্তারিত খবরটি না হলে আমার লেখার সাথে মিশে যাবে। উপজেলার গাংনী গ্রামের মৃত বাদল বিশ্বাসের স্ত্রী ক্ষেতমজুর রেখা বিশ্বাস জানান, প্রায় দুই বছর আগে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার আশ্রয়স্থলে (অন্যের জমিতে বসতঘর) গিয়ে তাকে বলেন, কৃষি ব্যাংক মোল্লাহাট শাখার আইও নেছার উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাকে আর্থিক সাহায্য করতেপারেন। সে মোতাবেক দেখা করলে আইও নেছার সাহেব বলেন, ছবি এবং সন্তানদের তালিকা দিলে দু-একদিনের মধ্যে কিছু টাকা অনুদান দিতে পারবেন। ওই দিনই কৃষি ব্যাংক মোল্লাহাট শাখার অদূরে হাসপাতাল মোড়ের এক দোকান থেকে ছবি তুলে নেছারের নিকট দিলে তিনি বলেন, অনুদানের টাকা রেডি করতে একটু সময় লাগবে এবং কিছু খরচাপাতি লাগে। তখন অভাব-অনটনের কথা বলতেই তিনি তার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেন, ঠিক আছে তুমি ফোন করে আসবা, আমি রেডি করি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করলে ৫-৬ দিন পর অক্ষরজ্ঞানহীন ওই কৃষাণীকেব্যাংকে ডেকে নিয়ে কয়েকটি টিপ রেখে ব্যাংকের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। পরে আইও নেছার সেখানে গিয়ে তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দেন এবং বলেন, খরচের টাকা রেখে এই টাকা দিলাম। বর্তমানে ওই ব্যাংকের আইও মিরাজুল ইসলাম তার স্থলে বদলি হয়ে আসার পর রেখাবিশ্বাসকে লোন পরিশোধের জন্য চাপ দেন। রেখা বিশ্বাসকে বলছেন, তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে কেবল ছবি এবং আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে চিনিয়ারা নামের অন্য এক নারীর পরিচয়ে ৮০ হাজার টাকা লোন নিয়েছেন। এমনকি ওই মুসলিম নারীর নিজস্ব জমিও লোন হিসেবে বন্ধক দেখানোহয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তার লোন প্রতারণা থেকে মুক্তির দাবিতে অক্ষরজ্ঞানহীন রেখা বিশ্বাস আরও বলেন, নিজস্ব কোন জমি/বসতবাড়ি না থাকায় অন্যের আশ্রয়ে থেকে তিনি ও তার এক মেয়ে এবং এক ছেলে বিভিন্ন লোকের জমিতে (ক্ষেত-খামারে) শ্রম বিক্রি করে সংসার চালানোসহঅতিকষ্টে এক মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নেছার উদ্দিন মোবাইল ফোনে জানান, গাংনী এলাকার জনৈক দালালকে বিশ্বাস করে তিনি বেকায়দায় পড়েছেন, কেবল রেখা বিশ্বাস ও চিনিয়ারাই নয়, তার সরলতার সুযোগে ওই দালাল মোট ১৩টি লোন তাকে দিয়েকরিয়েছেন, যার সবই হেড অফিসের মাধ্যমে তদন্ত চলছে। বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, যেহেতু রেখা বিশ্বাসের সংশ্লিষ্টতা আছে, সেহেতু বর্তমান আইও তার কাছে গেছেন। এছাড়া নেছারের বেশকিছু লোনে সমাস্যা রয়েছে। কৃষি ব্যাংকের এই শাখাটিতেই আমি চাকরি করেছি। তাই বিষয়গুলো আমার অজানা নয়। বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি হয় সেখানে, যেগুলো মানুষের পক্ষে ভেবে বের করা সম্ভব না। এক কথায় সঙ্গবদ্ধ লুটপাট। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি চাকরি হারিয়েছি। শুনতে অনেকের কাছে ভালো শুনাবেনা, ভাববেন, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ হেনস্থা হতে পারে, কিন্তু চাকরি কীভাবে হারায়। তাহলে গল্পটা বলি- ঘটনাটা সবসময় আমি চেপে রেখেছি, কারণ, একটু ‘দাঁড়িয়ে’ নিতে না পারলে উল্টে মানুষ আমাকে দোষ দিবে। এখনো ‘দাঁড়াতে’ না পারলেও বলছি তার কারণ এই সমাজে দাঁড়াতে হয়ত আর পারবই না, কিন্তু গল্পটা অনেকেব কাজে আসতে পারে। চয়েজ করে চাকরি নিয়েও কেন আমি কৃষি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলাম, এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি আমি বহুবার। কিন্তু সত্য ঘটনা সবসময় আমাকে চেপে যেতে হয়েছে। সবাইকে বলতে হয়েছে ভগিচগি একটা কিছু। তখন ঢাকা শহরে আমার যাচ্ছেতাই অবস্থা। একটি বিধ্বস্ত পরিবার নিয়ে টিউশনি করে, কোচিং করিয়ে, এস্পারওস্পার করে কিছুতেই আর চলতে পারছিলাম না। যেহেতু অংক-ইংরেজির ওপর ভালো দখল ছিল, তাই কৃষি ব্যাংকের চাকরিটা পেয়ে গেলাম। আমি কৃষি ব্যাংকের চাকরি চয়েজ করে নিয়েছেলিাম, কারণ, গ্রামের বাড়িতে থেকে ভালো বেতনে এই একটি চাকরিই করা যায়। তাছাড়া কৃষি ব্যাংক দেখে আসছি সেই ছোট বেলা থেকে, সে কারণেও আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। একসময় ছোটবেলায় আমার বিধবা মাও কৃষি ব্যাংকের হেনস্থারশিকার হয়েছিলেন, মামাদের কল্যানে পার পেয়েছিলাম। তাই এ ব্যাংকটাকে জীবনভর আমি ‘দেখে নেব’ বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমিই তো রোজ নিজেকে একবার করে প্রশ্ন করি- আমার সামনে কোনো বিকল্প ছিল কিনা। আসলে বিকল্প ছিল না। প্রশ্নটা করতে হয়, কারণ, অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আত্মীয় পরিজনের সেই আস্থার প্রতিদান দিতে না পারা, তাদের একটু ভালো রাখতে না পারার কষ্টটাআমাকে বয়ে বেড়াতে হয় এখন। তবে বৃহত্তর অর্থে চিন্তা করলে দুএকজনকে ভালো রাখার চেষ্টাটা আসলে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা নয়, তবে সে বুঝ দিয়ে সবসময় স্বান্তনা খুঁজে পাওয়া যায় না। বলতে থাকলে অনেক কথা চলে আসবে। থাক। কৃষি ব্যাংকরে চাকরি থেকে কেন আমি দূরে আছি সেটি ডিটেইলস বলি। তাতে আমার বোঝা অন্তত একটু হলেও কমবে, দুএকজন মানুষ উপকৃত হবে বলেও বিশ্বাস করি। আমি ১/১২/২০১১ তারিখে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বিভাগীয় কার্যালয় খুলনায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করি। ৫/১২/২০১১ তারিখে প্রথম কর্মস্থল হিসেবে মোল্লাহাট, বাগেরহাট শাখায় যোগদান করি। যোগাদানের পর আমি এতটাই কড়াকড়ির শিকার হই যে আমার মাস্টার্সপরীক্ষাও ঠিকমত দিতে পারিনি। একটি পরীক্ষা দিয়ে গিয়ে একদিন অফিশ করে পরের দিন ঢাকায় এসে আবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। উল্লেখ্য, নিয়োগ পরীক্ষার সমিম্মলিত ফলাফলে আমি চতুর্থ অবস্থানে ছিলাম। খুলনা অঞ্চলে যারা যোগদান করেছিলেন, তাদের মধ্যে আমিই প্রথম ছিলাম, কিন্তু আমার নামটি রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় অবস্থানে, এবং এটিই ছিল প্রথম অবিচার। এবং ঐ জিএমই শেষ পর্যন্ত আমাকে নাজেহালকরেছেন সবচেয়ে বেশি। কারণ, ব্রাঞ্চে এসে বিষয়টি আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। ব্রাঞ্চে কিছুদিন চাকরি করার পরে ট্রেনিং-এ যাই। এরপর বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে শাখায় ফিরলে আমাকে পুরনো লেজার, বিশেষ করে কু-ঋণগুলো হিসেব করে (যোগ করে) আলাদা কাগজে লিখতে বলা হয়। ব্যাড লোন (বিএল) বা কুঋণ হচ্ছে ব্যাংক যে লোনগুলো আর আদায় হবে না বলে ধরেনিয়েছে। কাজটি করতে গিয়ে আমার চোখে কিছু অসংগতি ধরা পড়ে। অসংগতিগুলো নিশ্চিত হয়, যখন আমাকে একজন দালালের সাথে টাকা আদায় করতে ফিল্ডে পাঠানো হয়। দেখলাম, ভয়ভীতি দেখিয়ে একেবারে ছা-পোষা মানুষের কাছ থেকে কু-ঋণের ওপর ৫০০/১০০০ টাকা বা যেমন সম্ভবআদায় করা হলেও তা খাতায় উঠছে না। এছাড়া ঋণ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসংগতি চোখে পড়ে। যেমন, ধরা যাক কেউ ২০,০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিল। সুদে আসলে তা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৫,০০০ টাকায়। তাকে বলা হল, যেহেতু তুমি শোধ করতে পারছ না, তুমি এবার ৪০,০০০ টাকা ঋণ নাও। সে চল্লিশ হাজার টাকা ঋণনিল, কিন্তু কোনো টাকা হাতে পেল না। তার পূর্বের ঋণ শোধ হল। আবার তার নামে ৩৫,০০০ টাকা ঋণ বরাদ্দ হল। ক্লোজিংএ ঋণ পরিশোধও হল, ঋণ প্রদানও হল। কিন্তু আসলে তো ব্যাংকও ঠকল, ব্যক্তিও ঠকল। এবং একইসাথে প্রশ্ন দাঁড়াল- মাঝখান দিয়ে ৫,০০০ টাকা কোথায় গেল? এর চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়ও আছে। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো আসল সুদে-আসলে দিগুণ হয়ে গেলে, তার ওপর আর সুদ চার্জ করা যায় না। মোল্লাহাটা শাখায় (আমি শুধু মোল্লাহাট শাখার কথা জানি) সে নিয়মেরও বালাই ছিল না। লেজারে নিয়মানুযায়ী টানা থাকলেও গ্রাহকদের কাছথেকে টাকা আদায় করা হত। ঋণ সমন্বয়ে গ্রাহকরা এবং ব্যাংক কীভাবে ঠকে সে বিষয়টি আর একটু পরিষ্কার করার প্রয়োজন রয়েছে। ধরা যাক, কেউ ঋণ নিয়েছিল ৩০,০০০ টাকা। সুদে-আসলে তা এখন ৫৮,০০০টাকা হয়েছে। টাকাটা আর ২,০০০ টাকা বাড়তে পারে। নিয়মানুযায়ী এর চেয়ে বেশি বাড়ার সুযোগ নেই।অর্থাৎ গ্রাহক যদি ঋণের টাকাটা শোধ করে, তাহলে সর্বোচ্চ তাকে ৬০,০০০ টাকা শোধ করতে হবে। কিন্তু ব্যাংক এক্ষেত্রে যেটা করে, ছা-পোষা গ্রাহককে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঋণ সমন্বয় করে দেয়। তার নামে এবার বরাদ্দ যদি হয় ৬০,০০০টাকা, তাহলে কোনো একদিন তাকে বা তার বংশধরকে সর্বোচ্চ শোধ করতে হবে ১,২০,০০০ টাকা। যেখানে সে ৬০,০০০ টাকা শোধ করে পারত, কোনোটাকা নতুন করে হাতে না পাওয়া সত্ত্বেও এবং ব্যাংকে কোনো টাকা জমা না হলেও ভবিষ্যতে তাকে শোধ করতে হবে ১,২০,০০০ টাকা। এরকম পদে পদে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে কৃষি ব্যাংকে। হয়ত অন্য ব্যাংকেও আছে, জানি না। এছাড়াও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এমন অনেক ঋণ ঐ শাখায় রয়েছে যে ঋণ গ্রহীতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। পদে পদে অনিয়ম রয়েছে বাগেরহাট, মোল্লাহাট শাখায়। বিষয়গুলো অমানবিক এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করে খুলনার তৎকালীন মহা ব্যবস্থাপক এবং কৃষি ব্যাংকেরতৎকালীন চেয়ারম্যান বরাবর দুটি মেইল করি। উক্ত মেইলের প্রেক্ষিতে বাগেরহাটের মূখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এবং খুলনা হতে আরো একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক বিষয়টি সরজমিনে তদন্তে আসেন। তবে মূলত, আমাকেই ওনারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, এবং মৌখিকভাবে বলেছিলেন, একজন নবাগত কর্মকর্তা হিসেবে আমার ওসব না দেখাই ভালো। এটা ছিল আসলে প্রচ্ছন্ন হুমকি। তারা রাগে কটমট করছিলেন, একজন তো আমার শশুরের নাম জিজ্ঞেস করে বসেন! এরপর ব্যাংক ম্যানেজার মি. আতিয়ার রহমান (শুনেছি দুর্নীতির দায়ে পরে ওনার বদলী হয়েছিল, তবে সেটি খুব মেজর কিছু না বলে মনে হয়, নিশ্চয়ই উনি উপরে টাকা দিয়ে সব ঠিক করে নিয়েছিলেন, কারণ, ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার হলেও তার মেয়ের গৃহশিক্ষকের বেতন ছিল তারতৎকালীন বেতনের চেয়ে বেছি, এ গল্প তিনি নিজেই আমার কাছে করেছিলেন।) আমাকে ইনএকটিভ রাখতে শুরু করেন। আমি স্বেচ্ছায় একাউন্ট খোলার কাজটি নিই। সেখানেও বিপত্তি বাধে, কারণ, ঐ শাখায় একাউন্ট খুলতে ৫০ টাকা করে নেওয়া হত। আমি টাকাটা না নেওয়ায় ট্রেন্ড নষ্টহয়, এবং তাতেও অন্যরা আমার উপর অসন্তুষ্ট হন। মাঝে মাঝে এমন অনেক ঘটনা শাখায় ঘটতে থাকে যে শাখায় চাকরি করাই খুব কঠিন হয়ে যায়। আমার জিনিসপত্র হারাতে থাকে, ব্যাগ হারিয়ে যায় ইত্যাদি। তারপরও আমি পরিস্থিতি মেনে নিয়ে কাজ করতে থাকি। এরপর হঠাৎ ১২/৮/২০১২ তারিখে আমার নামে মোল্লাহাট শাখায় একটি বদলীর আদেশ আসে। এবং সে মোতাবেক ০৬/০৯/২০১২ তারিখ, বৃহস্পতিবার আমি বিভাগীয় কার্যালয় বরিশালে যোগদান করি। মনে করেছিলাম, বরিশালেই আমার পোস্টিং, কিন্তু ঐদিনই আমার নামে আরেকটিবদলীর আদেশ করা হয়, এবং ০৯/০৯/২০১২ তারিখ, রবিবারের মধ্যে ভোলা জেলার চরফ্যাশন শাখায় যোগদান করতে বলা হয়। এই বদলী আদেশ ছিল অবৈধ, কারণ, নিয়মানুযায়ী একদিনে দুটি বদলী আদেশ হতে পারে না। এটা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন, কারণ, আমি যেহেতু পরিবারের একমাত্র ভরণপোষণকারী এবং মা অসুস্থ, তাই এত দ্রুত এরকম দুটি বদলীর সম্মুখিন হয়ে মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। তারপরেও জীবীকার তাগিদে অপমান মেনে নিয়ে ‘খোড়াতে খোড়াতে’ চরফ্যাশনশাখায় যোগদান করি। আমার হাত তখন একেবারে শূন্য। ব্যাংক থেকে লাঞ্চবাবদ যে ১৫০ টাকা পাওয়া যায়, ওটি দিয়ে কোনোমতে চলছি। মাসে শেষে বেতনের জন্য অপেক্ষা করছি, অপেক্ষা করছে বাড়িতে আরো চারজন। চরফ্যাশন শাখায় গিয়ে যা ঘটতে থাকে তা ছিল আরো অমানবিক। আমাকে শাস্তিপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে, যে ধরনের শাস্তি বড় ধরনের অনিয়ম বা চুরির দায়ে কাউকে দেওয়া হয়। আমি ছিলাম উধ্বর্তন কর্মকর্তা, কিন্তু চরফ্যাশন শাখায় আমাকে পরিদর্শকদের নিচে থেকেকাজ করতে হত। এছাড়াও অনেক আনঅফিশিয়াল ব্যাপার ঘটতে থাকে। অজানা মোবাইল নাম্বার থেকে হুমকি আসে ইত্যাদি। আমাকে এমন দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। চরফ্যাশন শাখায় কিছুদিন চাকরি করার পর মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং বাড়ি চলে যাই। শুক্রবার এবং শনিবার বাড়িতে থেকে আবার চাকরিতে যোগদান করার ইচ্ছে ছিল, তবে মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হওয়ায় আমি চাকরিতে যোগদানকরতে অসমর্থ হই এবং বিষয়টি চরফ্যাশন শাখার ব্যবস্থাপক মহোদয়কে ফোনে এবং টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানাই। আমি কৃষি ব্যাংকে লক্ষ্য নিয়ে যোগদান করেছিলাম। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর কৃষি ব্যাংকে আমাদের একটি ঋণ ছিল, যেটি শোধ করতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়েছিল। ছাত্র জীবনে আমি মনে মনে রেখেছিলাম, কৃষি ব্যাংকে চাকরি করতে হবে এবং বাড়িতে থাকতে হবে। কৃষিব্যাংকের চাকরির পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে চতুর্থ পজিশনে থেকে আমি যোগদান করেছিলাম। খুলনা অঞ্চলে মেরিট লিস্টে আমি এক নম্বরে ছিলাম, যেটি আগেই উল্লেখ করেছি। যাইহোক, এরপর আমার মানসিক অবস্থা খুবই বাজে অবস্থায় পৌঁছায়। বাড়িতে বসবাস করার মত অবস্থাও আমাদের তখন ছিল না। বাধ্য হয়ে মা এবং ‘ভিন্নধর্মীনীকে’ নিয়ে ঢাকায় চলে আসি এবং নিজের চিকিৎসা করাই, মায়ের চিকিৎসা করাই। চিকিৎসায় আমার ক্রোনিক ডিপ্রেসনের পাশাপাশি প্যানক্রিয়েটিক সমস্যা ধরা পড়ে। কোনো খাবার হজম হত না। তখন আমার অতল সমুদ্রে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। বুঝে পেতাম না কী করা উচিৎ। একটি প্রকাশনীর সাথে লেখালেখি করতাম, তারা একলাখ টাকা দিয়ে হেল্প করে। তখনমনে হল, তাহলে বিসিএস ভাইভাটা ভালোভাবে দিই। এবং বিসিএস হলে ব্যাংকে আর যোগদান করব না। এরপর মূল সার্টিফিকেটের প্রয়োজনে হেড অফিশে যোগাযোগ করি। কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগ-১ হতে জানতে পারি যে আমার সার্টিফিকেট হেড অফিশে নেই, ওটি রাখা হয়েছে বরিশাল জিএম অফিশে। যেটি একেবারেই আইনবহির্ভূত। এরপর কী করেছিলাম আমার ঠিক মনে নেই, তবে চরফ্যাশনের শাখা ব্যবস্থাপক মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। সর্বশেষ সার্টিফিকেট আনতে শাখায় গেলে আমাকে আঞ্চলিক অফিশে যোগাযোগ করতে বলা হয়, আঞ্চলিক অফিশে যোগাযোগ করলে আমাকে একমাত্র রিজাইন দেওয়ারমাধ্যমে সার্টিফিকেট নিতে হবে বলে জানানো হয়। অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমি বাধ্য হয়ে রিজাইন দিয়ে সার্টিফিকেট নিই। তবে ঢাকায় এসে একটি মেইল করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয়কে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। এবং এরপর মাঝে মাঝে চেষ্ট করেছি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে চাকরিতেআবার যোগদান করতে। একইসাথে তখনও আমি ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে। চাকরিতে যোগদান করার মত যথেষ্ট ফিট ছিলাম না। সবমিলিয়ে একটা লম্বা সময় কেটে যায়। এরপর যতই চেষ্টা করি না কেন কোনোভাবেই বিষয়টি আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আর আনতে পারিনি।